Thursday, 28 August 2025

ট্রাম্পের কূটনৈতিক খেলায় ভারতের পরাজয়

এম এ হোসাইন,

কূটনীতির কার্যশৈলী অনেক সময় ভ্রমাত্মক হয়। ২০১৯ সালের হিউস্টনে অনুষ্ঠিত “হাউডি মোদি” সমাবেশ কিংবা পরের বছর আহমেদাবাদের “নমস্তে ট্রাম্প” সমাবেশ, এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না। ঐ দুটো আয়োজনই সুচারুভাবে সাজানো হয়েছিল, যাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যকার আন্তরিক সম্পর্ক প্রদর্শিত হয়। যেন এটি ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা হিসেবে বিশ্ব মঞ্চে আলোচিত হয়। কিন্তু ২০২৫ সালে ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পর ভারতের সাথে অভাবনীয় দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেছে; যেখানে বারবার অবজ্ঞার শিকার হতে হয়েছে ভারতকে। যেমন কখনো শুল্ক আরোপ, প্রকাশ্য ভর্ৎসনা, আবার ধারাবাহিকভাবে কৌশলগত উপেক্ষা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকগন নানাভাবে এই অবনতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনেকে মনে করেন, ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোদির নিরপেক্ষ অবস্থান ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করেছিলো। আবার কেউ বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের মধ্যস্থতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ট্রাম্প ভারতকে শাস্তি দিচ্ছেন। কিন্তু এগুলো কেবল একধরনের ব্যাখ্যা মাত্র। আসল সত্য হলো, ভারত আমেরিকার অভিপ্রায় ও সক্ষমতাকে মৌলিকভাবে বুঝতে মারাত্মক ভুল করেছে। যার ফলে, দিল্লী আজ ভূরাজনৈতিকভাবে দুর্বল, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং কূটনৈতিকভাবে দিশাহীন হয়ে পড়েছে।

ভারতের এই ভুল বুঝার প্রবণতা ইতিহাসে আরও রয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথম দিকেই আমেরিকান নেতারা ভারতের গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রশংসা করলেও অচিরেই তারা বিরক্ত হয়ে উঠে ভারতের জোট নিরপেক্ষতা আর সোভিয়েত ঘনিষ্ঠতায়। শীতল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সম্পর্কে কিছুটা উন্নত হয়। জর্জ ডব্লিউ বুশের আমল থেকে আমেরিকা ভারতকে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে শুরু করে। কিন্তু ভারতীয় কৌশলবিদেরা যেটিকে ভারতের ‘মহাশক্তি’ মর্যাদার স্বীকৃতি মনে করেছিলেন, তা আসলে ছিল আমেরিকার ইনডো-প্যাসিফিক কৌশলে ভারতকে আরও শক্তভাবে বাঁধার পরিকল্পনা।

দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ইতিহাসও এই বৈষম্যই দেখায়। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে পারমাণবিক নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড়িয়ে আনে, যার ফলে ভারত পারমাণবিক প্রযুক্তি পায়। দিল্লী একে জ্বালানি ক্ষেত্রে বিপ্লব ভেবেছিল, কিন্তু আমেরিকার আসল প্রাপ্তি ছিল বাণিজ্যিক—ভারতের পারমাণবিক খাতে মার্কিন কোম্পানির প্রবেশাধিকার। ভারতকে পুরনো প্রযুক্তির জন্য উচ্চমূল্য গুনতে হয়, আর সস্তা ও আধুনিক রুশ ও চীনা বিকল্পকে উপেক্ষা করতে হয়। ২০০৮ সালের বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তিও, যা দিল্লী মহাকৌশলগত সাফল্য ভেবেছিল, আসলে তা ছিল আমেরিকার বাণিজ্যিক স্বার্থ। পরবর্তী প্রতিরক্ষা চুক্তি—২০১৬ সালের LEMOA (Logistics Exchange Memorandum of Agreement), ২০১৮ সালের COMCASA (Communications Compatibility and Security Agreement), এবং ২০২০ সালের BECA (Basic Exchange and Cooperation Agreement for Geospatial Intelligence)—ভারতের ধারণা ছিল এগুলো চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে। বাস্তবে এগুলো নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে। ২০১৭ সালের ডোকলাম সংঘাত আর ২০২০ সালের গালওয়ান রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ প্রমাণ করে, আমেরিকার আশ্বাস চীনের আচরণ বদলাতে সামান্যই ভূমিকা রেখেছিল। ওয়াশিংটন এই চুক্তিগুলো ব্যবহার করেছে ভারতকে তাদের কৌশলগত কাঠামোয় বেঁধে রাখতে, আর দিল্লী আঁকড়ে ধরেছিল সমতার ভ্রান্ত ধারণা।

অর্থনৈতিক ভুলপাঠও ভারতের জন্য ব্যয়বহুল হয়েছে। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নীতিনির্ধারকেরা ভেবেছিলেন, আমেরিকা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বায়ন স্থায়ী। অথচ তখনই এর ভিত কাঁপছিল। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেই শুল্ক ও সুরক্ষাবাদ শুরু হয়। বাইডেন ভাষায় নরম হলেও বাস্তবে উৎপাদন ফিরিয়ে আনা এবং জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মিত্রদের প্রাধান্য দেন। ২০২৫ সালে ট্রাম্প ফেরার সময় বিশ্বায়ন থেকে সরে আসা পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু ভারত তখনো অপ্রস্তুত—ভাবছিল, চীনের মতো ১৯৯০-এর দশকে বাণিজ্যিক ছাড় পাবে। বাস্তবে ট্রাম্প ২০১৯ সালে ভারতের জিএসপি সুবিধা বাতিল করেন এবং ২০২৫ সালে ভারতীয় পণ্যে প্রথমে ২৫ শতাংশ, পরে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন—রুশ তেল কেনার অজুহাতে।

ফল হয়েছে ভয়াবহ। শুধু প্রযুক্তিখাত রপ্তানিতেই ক্ষতি ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার। জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমে গেছে প্রায় আধা শতাংশ পর্যন্ত। টেক্সটাইল ও চামড়ার ক্ষুদ্র শিল্প বিলুপ্তির পথে, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে। রুপি দুর্বল, শেয়ারবাজার টলমল, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের গর্বিত ২০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য সম্পর্ক সংকটে। দিল্লী ভুল পড়েছিল শুধু আমেরিকার অভিপ্রায় নয়, তার সক্ষমতাকেও। ওয়াশিংটনের আছে আঘাত করার ক্ষমতা, আর প্রয়োগ করার ইচ্ছাও।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীনকে ঘিরে আমেরিকার কৌশল নিয়ে ভারতের ভুল বোঝাবুঝি। দীর্ঘদিন দিল্লী ভেবেছে, আমেরিকার চীনবিরোধী অবস্থান মানেই ভারতের নিঃশর্ত সমর্থন। কৌশলবিদেরা কোয়াডকে ভরসা করেছেন, প্রতিরক্ষা চুক্তিকে প্রতিরোধ সংকেত ভেবেছেন, আর সীমান্ত উত্তেজনা বাড়তে দিয়েছেন। ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষ তার করুণ ফল। অথচ ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্য কখনোই ভারতকে সমকক্ষ অংশীদার বানানো ছিল না। বরং স্বল্পমেয়াদে চীনের ভারসাম্য রক্ষায় ভারতকে ব্যবহার করা, আর দীর্ঘমেয়াদে ভারতের উত্থান ঠেকানো। যখন কোয়াড চীনের গতিপথ বদলাতে ব্যর্থ হলো, তখন আমেরিকার চাপ নেমে এলো ভারতের উপরেই—রুশ তেল আমদানিতে সমালোচনা, শুল্ক আরোপ, আর মানবাধিকার প্রশ্নে আঙুল তোলা।

এই ফাঁকে চীন সুযোগ নিয়েছে। ২০২৪ সালের সীমান্ত-উত্তেজনা প্রশমন চুক্তি সামরিক উত্তেজনা কমিয়েছে। ২০২৫ সালে পাঁচ বছর পর দু’দেশের সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হয়েছে, বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো খুলেছে, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে, উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক সংলাপ ফিরেছে। মোদি নিজেই সম্পর্কের “স্থিতিশীল অগ্রগতি”র প্রশংসা করেছেন। বিদ্রূপাত্মক সত্য হলো—আমেরিকার চাপই ভারতকে ঠেলে দিয়েছে সেই শক্তির দিকে, যাকে নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল লক্ষ্য।

চীনের সঙ্গে পার্থক্যটা চোখে পড়ার মতো। বেইজিং দক্ষতার সঙ্গে কৌশলগত প্রজ্ঞা প্রয়োগ করেছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা তৈরি করেছে এবং একই সঙ্গে নিজের উচ্চাভিলাষ আড়াল করেছে। অন্যদিকে ভারত অতিরিক্ত স্বচ্ছ থেকেছে—মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলোতে প্রবেশ করেছে সমতার ভিত্তিতে ভেবে, ক্ষণস্থায়ী লেনদেনকে ভেবেছে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রতিশ্রুতি, আর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষণিক উজ্জ্বলতার জন্য বিসর্জন দিয়েছে স্বায়ত্তশাসন।

এই ভুলপাঠের খরচ প্রতিদিন বাড়ছে। অর্থনীতিতে শুল্ক রপ্তানি খাত ভেঙে দিচ্ছে, প্রবৃদ্ধি ঝুঁকিতে ফেলছে। কৌশলে, মার্কিন অস্ত্রনির্ভরতা চীনকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। কূটনীতিতে, ভারত একা হয়ে পড়েছে—বছরের পর বছর বেইজিংকে দূরে সরিয়ে এখন কেবল সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা, আর ওয়াশিংটনের কাছ থেকে পাওয়া কেবল লেনদেনমূলক গুরুত্ব। পরিস্থিতি এক পুরনো উপমার মতো, "হাতলবিহীন ভারী স্যুটকেসের মতো" ভারত যা বহন করার মতো ভারী, ফেলে দেওয়ার মতো দামী।

এখন ভারতের সামনে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সময়। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই তাকে সমকক্ষ অংশীদার ভাববে না—আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি চলে স্বার্থে, আবেগে নয়। দ্বিতীয়ত, ভারতকে স্বায়ত্তশাসনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, ইউরোপ, রাশিয়া ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক গড়তে হবে। সবচেয়ে জরুরি, কৌশলগত প্রজ্ঞার প্রয়োগ শিখতে হবে—সহযোগিতা করেও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা, যেমনটি চীন তার কূটনীতিতে করেছে।

ইতিহাস সতর্কবার্তা দেয়। শীতল যুদ্ধকালে এবং পরবর্তীতে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তান নিজেকে আমেরিকার ‘অপরিহার্য মিত্র’ ভেবেছিল। উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে ওয়াশিংটন তাকে পরিত্যাগ করে। ভারতও একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে, যদি না ভূরাজনীতির কঠিন সত্যটি বুঝতে পারে, ভূরাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু নেই, আছে কেবল স্বার্থের মিলন।

“হাউডি মোদি” আর “নমস্তে ট্রাম্প”-এর চাকচিক্য এখন অতীত। যা বাকি আছে, তা হলো কঠিন বাস্তব—শুল্ক, কৌশলগত হতাশা, আর বেড়ে চলা দুর্বলতা। ভারত আমেরিকার অভিপ্রায়কে সদয় ভেবেছে, আর সক্ষমতাকে সীমিত ভেবেছে। দুই ক্ষেত্রেই ভুল করেছে। পুনরুদ্ধারের জন্য দিল্লীকে ভ্রান্তি ঝেড়ে ফেলে বাস্তববাদী হতে হবে। স্বায়ত্তশাসন, ভারসাম্য আর কৌশলগত প্রজ্ঞা—শুধুই এগুলো ভারতের পথ দেখাতে পারে। অন্যথায়, ওয়াশিংটনের চোখে ভারত থাকবে বর্তমান অবস্থাতেই: কার্যকর, কিন্তু কখনোই অপরিহার্য নয়।



লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। 


এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে : 

১. সময়ের আলো, ঢাকা : ২৬ আগষ্ট, ২৫

২. দেশ রূপান্তর, ঢাকা : ২৬ আগষ্ট, ২৫

No comments:

Post a Comment