Friday, 12 September 2025

থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে আনুতিনের উত্থান!

এম. এ. হোসাইন,

থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন আনুতিন চার্নভিরাকুল। এর মধ্য দিয়ে শুরু হলো দেশের রাজনৈতিক নাটকের আরেকটি অধ্যায়। গত ৫ই সেপ্টেম্বর তিনি শপথ নেন, যার মাধ্যমে কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক সংকটের সমাপ্তি ঘটে।  তাঁর উত্থান কোনো ব্যাপক নির্বাচনী ম্যান্ডেট বা দৃঢ় সংস্কার-কার্যসূচির ফল নয়। বরং এটি ছিল সুযোগসন্ধানী রাজনীতির বিজয়ের এমন এক দৃষ্টান্ত যা সময়োপযোগী, নির্মম বাস্তববাদ এবং থাই রাজনীতির দীর্ঘস্থায়ী ধারা ও প্রবণতার উন্মোচন।

৫৮ বছর বয়সী আনুতিন ক্ষমতার বলয়ে অচেনা কেউ নন। তিনি রাজনৈতিক বৃত্তের ভেতরেরই মানুষ। যিনি সম্পদশালী পরিবারে জন্মেছেন, রাজনীতির কাছাকাছি বেড়ে উঠেছেন, আর থাইল্যান্ডের গভীরভাবে মেরুকৃত প্রেক্ষাপটে দক্ষভাবে পথ চলার কৌশল আয়ত্ত করেছেন। গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশটি বিভাজিত থেকেছে এক তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। একদিকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তাকসিন শিনাওয়াত্রার জনবান্ধন উত্তরাধিকার, যা গ্রামীণ ভোটারদের কাছে প্রিয়; অন্যদিকে, রাজতন্ত্রী-মিলিটারি এলিটদের জোট, যাদের লক্ষ্য সেই জনবান্ধববাদকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। অধিকাংশ রাজনীতিবিদকে এক পক্ষ বেছে নিতে হয়। আনুতিন বারবারই দু’পক্ষকেই বেছে নিয়েছেন।

তাঁর রাজনৈতিক জীবন যেন অভিযোজনের নিখুঁত উদাহরণ। নব্বইয়ের দশকে রাজনীতিতে পা রাখা, ২০০০ সালের শুরুতে তাকসিনপন্থী হয়ে উঠা, ২০০৬ সালের অভ্যুত্থানের পর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবসায় সরে যাওয়া, পরে ভুমজাইথাই পার্টির নেতৃত্বে রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন, ২০১৯ সালে তাকসিনের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রায়ুথ চান-ওচাকে ক্ষমতায় বসাতে কিংমেকারের ভূমিকা, আর ২০২৩ সালে তাকসিনেরই দলের নেতৃত্বাধীন জোটে স্বাচ্ছন্দ্যে উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন—সবই ছিল ধাপে ধাপে সাজানো কৌশলের অংশ। শেষ পর্যন্ত, এক কেলেঙ্কারিতে পেতংতার্ন সরে দাঁড়াতেই আনুতিন দেশটির সর্বোচ্চ পদে আসীন হলেন। তাঁর প্রতিটি বাঁক ছিল আদর্শ পরিবর্তনের গল্প নয়, বরং নিখুঁত রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের প্রতিফলন।

থাইল্যান্ড এমন নমনীয় রাজনৈতিক কৌশলকে পুরস্কৃত করার ক্ষেত্রে প্রথম কোন দেশ নয়। ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ আছে, যেখানে টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিক নমনীয়তা ছিল অপরিহার্য। যুদ্ধ-পরবর্তী ইতালিতে একের পর এক সরকার গঠন ও ভেঙে পড়েছে, জোট বদলেছে, দল গড়েছে ও ভেঙেছে। জাপানের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ধারাবাহিক নেতৃত্ব বদলের মাঝেও অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী-রাজনীতিকে স্থিতিশীলতার হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু থাইল্যান্ডের অস্থিরতা আলাদা—এখানে একদিকে রয়েছে আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র, অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক সামরিক ভেটো ক্ষমতা, আর তার সঙ্গে এমন এক রাজতন্ত্র যার প্রভাব সংবিধানগতভাবে সীমিত হলেও বাস্তবে এখনো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।

যে ঘটনার ফলে আনুতিন ক্ষমতায় এলেন, সেটিই এই অস্থিরতার উদাহরণ। কম্বোডিয়ার সিনেট প্রেসিডেন্ট হুন সেনের সঙ্গে এক ফোনালাপে পায়তংতার্নের কিছু অবহেলাসূচক মন্তব্য (যা পরে ফাঁস হয়)করেন, যা সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ে সামরিক বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ জেনারেলকে অপমান করে বলা হয়েছিলো। এরফলে জনরোষ ছড়িয়ে পড়ে। সংবিধান আদালত দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে পরে নৈতিক লঙ্ঘনের অভিযোগে সরিয়ে দেয়। জোট ভেঙে পড়ে। আনুতিন তাঁর দল ক্ষমতাসীন জোট থেকে প্রত্যাহার করেন, মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন, এবং নিজেকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর সামনে উপস্থাপন করেন। এটি ছিল থাই রাজনীতির পাঠ্যবই-ধাঁচের দৃশ্যপট: কোনো আদর্শ নেই, নতুন কোনো জনমত নেই, কেবল পুরনো খেলোয়াড়দের মধ্যে ক্ষমতার আসনবদল।

থাইল্যান্ডের ভবিষ্যৎ বোঝার জন্য জরুরি হলো দেশের দীর্ঘস্থায়ী অসামঞ্জস্যের দিকে ফিরে দেখা। এটি হলো নাগরিক সরকার ও সামরিক ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা। বহুদিন ধরেই সেনাবাহিনী নিজেদেরকে অভিভাবকের ভূমিকায় দাবি করে আসছে—কখনো প্রকাশ্যে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, কখনো বা নিঃশব্দে প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব খাটিয়ে। ২০২৫ সালের কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত শুধু সেই হাতকেই কেবল শক্তিশালী করেছে। সংকটের সময় সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রায়ই সরকারকে এড়িয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করেছে। জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, নিরাপত্তা বিষয়ক ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী এখনো সবচেয়ে বেশি আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান—যা শুধু তাদের সামর্থ্যের প্রতিফলন নয়, বরং বেসামরিক সরকারের দীর্ঘস্থায়ী ভঙ্গুরতারও প্রতিচ্ছবি।

আনুতিনের পক্ষে এই সমীকরণ চ্যালেঞ্জ করা সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাঁর দল নিজেই রক্ষণশীল, রাজতন্ত্রপন্থী, এবং আঞ্চলিক পৃষ্ঠপোষক নেটওয়ার্কের সাথে গভীরভাবে যুক্ত, যা সামরিক সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল। বর্তমান সাংবিধান (যা কিনা অভ্যুত্থান-পরবর্তী কৌশলের প্রতিফল) কাঠামোগতভাবে রক্ষণশীল ও সেনা-সমর্থিত এলিটদের সুবিধা দেয়। নাগরিক শ্রেষ্ঠত্ব আপাতত শুধু আকাঙ্ক্ষিত, বাস্তব নয়। আনুতিনের অধীনে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক আগের মতোই চলতে পারে যেখানে জেনারেলরা নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন, আর নাগরিক সরকার সীমিত ক্ষমতা নিয়ে দৈনন্দিন প্রশাসন চালাবে।

অর্থনৈতিক চিত্রও জটিল। রাজনৈতিক সংকটে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কেঁপে উঠেছে। ২০২৬ সালের বাজেট বিলম্বিত হয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় বাণিজ্য আলোচনার ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন—জিডিপি প্রবৃদ্ধি মন্থর হবে, বিদেশি বিনিয়োগ দ্বিধাগ্রস্ত হবে, আর নীতি হবে শুধু জোট বাঁচানোর কৌশলে ব্যস্ত, সংস্কারে নয়। এই অর্থে, থাইল্যান্ড ঝুঁকছে সেই বিস্তৃত আঞ্চলিক প্রবণতার দিকে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে স্পষ্ট: যেখানে সরকার জাতি-গঠন নয়, জোট রক্ষায় মগ্ন।

সামাজিক পরিণতিও উপেক্ষা করা যায় না। তাকসিন-কন্যা পেতংতার্নের পতন (যিনি একসময় শিনাওয়াত্রা পরিবারের পরবর্তী নেতৃত্ব হিসেবে বিবেচিত ছিলেন) ইঙ্গিত দেয় শিনাওয়াত্রা পরিবারের দীর্ঘ প্রভাব হয়তো ক্ষয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটি সেই গভীর বিভাজন দূর করতে পারছে না—গ্রামীণ জনবান্ধব রাজনীতি ও নগর রক্ষণশীলতার মধ্যে, সংস্কারের দাবিদার ও পুরনো অভিজাত অভিভাবক-প্রবৃত্তির মধ্যে। বরং এটি হয়তো এই বিভাজন আরও তীব্র করে তুলবে। থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক কেন্দ্র ধরে রাখা সম্ভব হয়নি; কেবল অস্থায়ীভাবে সরে গেছে এমন একজনের দিকে, যিনি এই ভাঙনরেখাগুলোর মধ্যে দিয়ে সাবলীলভাবে পথ খুঁজে নিতে জানেন।

গণবিক্ষোভ রয়ে গেছে অনিশ্চিত উপাদান হিসেবে। থাইল্যান্ডের ইতিহাস শেখায়, জনতার জাগরণ রাজনৈতিক হিসাব উল্টে দিতে পারে, তবে কেবল তখনই, যদি তা সামরিক বাহিনীকে বিভক্ত বা নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়। বিশ্বব্যাপী নাগরিক প্রতিরোধ আন্দোলনের গবেষণায় দেখা গেছে, বিস্তৃত, অহিংস, শ্রেণি-পার হয়ে গড়া জোটই সংস্কার বা ক্ষমতা পরিবর্তনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিপরীতে, খণ্ডিত, সহিংস বা দলীয় স্বার্থে সীমাবদ্ধ আন্দোলন সাধারণত দমননীতিকে উসকে দেয় এবং কর্তৃত্ববাদী প্রতিক্রিয়া আরও দৃঢ় করে তোলে। থাইল্যান্ডে সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেয়ে স্থিতিশীলতাকেই অগ্রাধিকার দেয়। যতক্ষণ না বিক্ষোভ সেনাবাহিনীর ভেতরের ঐক্যকে ভেঙে দেয় অথবা দমননীতির খরচ অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়, ততক্ষণ স্থিতাবস্থা বজায় থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

আনুতিনের নিজের রাজনৈতিক রেকর্ড থেকেও তেমন কোনো ইঙ্গিত মেলে না যে তিনি কোনো রূপান্তরমূলক নেতা হতে চান। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত নীতি-সিদ্ধি (২০২২ সালে গাঁজা বৈধকরণ) সাহসী ছিল, কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন থেকে যায়, যার ফলে পরবর্তীতে দেশকে তড়িঘড়ি করে সুরক্ষা-বিধি তৈরি করতে হয়। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় তাঁর ভূমিকা কিছু ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় হলেও, অনেক দিকেই ছিল শ্লথ, বিশেষ করে টিকা সংগ্রহে দেরি ও প্রতিরক্ষামূলক জনসম্মুখ মন্তব্যের কারণে সমালোচিত। তাঁর দলকে ঘিরে নির্বাচনী কারসাজি ও ভূমি-ব্যবহার সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগগুলো তাঁকে যেন ঘন মেঘের মতো ঘিরে রেখেছে—এখনই ঝড় নয়, কিন্তু স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় তিনি এক ধোঁয়াশাচ্ছন্ন রাজনৈতিক পরিবেশেই স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।

সুতরাং, থাইল্যান্ড এক অদ্ভুত দ্বৈততায় দাঁড়িয়ে আছে। দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত তাঁর প্রজন্মের সবচেয়ে দক্ষ সমঝোতাকারী, কিন্তু তাঁর দক্ষতা মূলত বিদ্যমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখায়, সংস্কার করতে নয়। দেশটি আটকে আছে এমন এক সমীকরণে—যেখানে ভোটাররা একসাথে স্থিতিশীলতা ও পরিবর্তন চায়, সামরিক বাহিনী তার বিশেষ অধিকারকে কোনো চ্যালেঞ্জ বরদাশত করে না, আর রাজতন্ত্র নীরব থাকলেও রাজনৈতিক কল্পনাশক্তির উপর মহাকর্ষীয় টান তৈরি করে। এই বাস্তবতায়, টিকে থাকাকে প্রায়শই অগ্রগতি মনে হয়।

ইতিহাস বলে, এ ধরনের ব্যবস্থা টিকে থাকে—যতক্ষণ না ভেঙে পড়ে। রোমান প্রজাতন্ত্র শেষের দিকে এক ধরনের সাংবিধানিক রাজনীতির আবরণ বজায় রেখেছিল, অথচ ক্ষমতা ক্রমশ কম লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ পুরোনো কাঠামোকে অচল করে দেয়। সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তান দশকের পর দশক ঘুরেছে বেসামরিক সরকার ও সামরিক হস্তক্ষেপের মধ্যে, প্রতিটি চক্র প্রতিষ্ঠানিক আস্থাকে ক্ষয় করেছে, অথচ তাৎক্ষণিকভাবে এলিটদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। থাইল্যান্ড একই পথে ঝুঁকছে—চলমান অস্থিরতা, মাঝেমধ্যে এমন এক শান্তি, যাকে ভুলবশত ঐকমত্য ভেবে নেওয়া হয়।

এই মুহূর্তে থাইল্যান্ডের রাজনীতি আগের মতোই রয়ে গেছে—বাস্তববাদী, ব্যক্তিনির্ভর, আর চিরকালীনভাবে অস্থির। আনুতিন চার্নভিরাকুল হয়েছেন এর সর্বশেষ রক্ষক, কোনো ভাঙন সৃষ্টিকারী নন। এই চিত্র বদলাবে কি না, তা নির্ভর করবে তাঁর ব্যক্তিগত প্রবৃত্তির চেয়ে অনেক বেশি সেই সব শক্তির (সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক) উপর যাদের সীমার মধ্যে থেকেই যেকোনো থাই নেতাকে পথ চলতে হয়। আপাতত স্থিতিশীলতা হয়তো টিকে থাকবে কিছু সময়। কিন্তু এমন এক ব্যবস্থায়, যা কোন টেকসই প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং সমঝোতা ও ক্ষমতার বাণিজ্যের উপর দাঁড়িয়ে। এইরূপ পরিস্থিতিতে পরবর্তী সংকট কখনোই বেশি দূরে থাকে না।



লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। 


 এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :

১. সময়ের আলো, ঢাকা : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২৫

No comments:

Post a Comment