এম এ হোসাইন,
আঙ্কোরেজ, আলাস্কা—বিশ্ব কূটনীতির মানচিত্রে এ শহরের নাম সচরাচর উঠে আসে না। তবুও মিশিগানের ম্যাকম্বে এক শীতল দিনে বিশ্বজুড়ে মনে করিয়ে দেওয়া হলো যে মহাশক্তির রাজনীতি প্রায়ই অপ্রত্যাশিত মঞ্চে জীবন্ত হয়ে ওঠে। সেখানেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মুখোমুখি বৈঠকে বসলেন, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত—রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ।
এ বৈঠকটি ঐতিহাসিক ছিল এক বিশেষ কারণে: রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের (২০২২) শুরুর পর এই প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট সরাসরি পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। প্রতীকী দিক ছিল স্পষ্ট—মস্কো থেকে আগত পুতিনকে আঙ্কোরেজের এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন সামরিক ঘাঁটিতে লালগালিচা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়, একই সময়ে আকাশে গর্জন তোলে মার্কিন বি-৫২ স্টিলথ যুদ্ধবিমান। এই মঞ্চায়ন ছিল সমতা, শক্তি এবং পুনর্মিলনের ক্ষীণ সম্ভাবনার ইঙ্গিত। কিন্তু ইতিহাস বারবার মনে করায়—শুধু প্রতীকী পদক্ষেপ দিয়ে কূটনীতি টিকে না।
ট্রাম্পের উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। তিনি সবসময় এমন এক বর্ণনা দাঁড় করাতে চান যাতে তার প্রেসিডেন্সি চিহ্নিত হয় বৈশ্বিক রাষ্ট্রনায়কত্বে। তিনি প্রায়ই দাবি করেন যে তিনি “ছয়টি বড় যুদ্ধ” প্রতিরোধ করেছেন—দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত নানা উদাহরণ টেনে আনেন। আর্মেনিয়া–আজারবাইজান যুদ্ধবিরতি বা ভারত–পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনের কৃতিত্বও তিনি নিজের ঝুলিতে রাখেন। এসব দিয়ে তিনি নিজের সেই চিত্রটি আঁকেন—বিশ্বের একমাত্র অদ্বিতীয় সমঝোতাকারী, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারকে কল্পনা নয়, বরং তার স্বাভাবিক প্রাপ্য মনে করেন। ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারলে বিশ্ব অবশেষে স্বীকার করবে: তিনি ইতিহাসের অনিচ্ছুক শান্তিদূত।
তবে তিন ঘণ্টার আলোচনার পর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হলো না। ট্রাম্প নিজেই স্বীকার করলেন: “চুক্তি তো তখনই হয়, যখন আসলেই চুক্তি হয়।” এ উক্তি একদিকে হতে পারে বাস্তববাদী সতর্কতা, অন্যদিকে বিশাল ব্যবধানের স্বীকৃতি। পুতিন বৈঠককে “বাস্তব সম্পর্কের একটি রেফারেন্স পয়েন্ট” বলে বর্ণনা করলেও কোনো স্পষ্ট প্রস্তাব দিলেন না। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন না ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন: ইউক্রেন ভূমি ছাড়বে না, দখলকৃত অঞ্চলের বৈধতা স্বীকার করবে না।
এখানেই ট্রাম্পের জুয়া স্পষ্ট হয়। তিনি দাবি করেন ইউক্রেনের হয়ে দরকষাকষি করছেন না, বরং তাদের আলোচনার টেবিলে আনতে চাইছেন। বাস্তবে এ অবস্থান ইতিহাসের কিছু ঝুঁকিপূর্ণ নজির মনে করিয়ে দেয় যেখানে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলিকে পাশ কাটিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলো শান্তি চাপিয়ে দিয়েছে। ১৯৩৮ সালের মিউনিখ চুক্তিই তার উজ্জ্বল উদাহরণ—ব্রিটেন ও ফ্রান্স হিটলারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল চেকোস্লোভাকিয়াকে বাদ দিয়ে। ফলাফল শান্তি নয়, বরং যুদ্ধের পথ প্রশস্ত করেছিলো। ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে ট্রাম্প–পুতিন আলাপ সেই একই বিপজ্জনক পুনরাবৃত্তি হওয়ার ঝুঁকি রাখে।
স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপের নেতারা উদ্বিগ্ন। চেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ান লিপাভস্কি কটাক্ষ করে বললেন, আলাস্কা বৈঠকের সময়ও রাশিয়ার হামলা অব্যাহত ছিল। ইউরোপের ভয় হলো—ট্রাম্প যদি দ্রুত কোনো কূটনৈতিক “জয়” চান, তবে তিনি ইউক্রেনকে সার্বভৌমত্বহানি-সংশ্লিষ্ট ছাড় দিতে বাধ্য করতে পারেন। ইউরোপের মতে, এ ধরনের “শান্তি”—যেখানে রাশিয়া দখলকৃত ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে শেকড় গাড়বে, আসলে তা হবে শান্তির চেয়েও ভয়ংকর।
তবুও সম্মেলনকে একেবারে বাতিল করে দেওয়াও ভুল হবে। ইতিহাসে মিউনিখের বিপরীত দৃষ্টান্তও আছে। ১৯৮৬ সালের রোনাল্ড রিগ্যান ও মিখাইল গর্ভাচেভ এর রেইকিয়াভিক বৈঠকটি প্রায় ভেঙে পড়লেও, তা শেষমেশ পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস চুক্তির পথ প্রশস্ত করে। গভীর অবিশ্বাসের মাঝেও ধৈর্যশীল আলোচনায় সোভিয়েত ও আমেরিকা কিছুটা সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিল। প্রশ্ন হলো—আলাস্কা কি আধুনিক রেইকিয়াভিক হয়ে উঠতে পারে, যেখানে আপাতত কিছু না হলেও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার বীজ রোপিত হলো?
তাহলে আসল প্রশ্ন—আলাস্কা সম্মেলন শান্তি আনল কি না তার উত্তর স্পষ্ট: না। কিন্তু এটি কি ভিন্নধর্মী কূটনীতির জন্য কোনো ক্ষেত্র তৈরি করল? ট্রাম্প যদিও ইউরোপে অপ্রিয়, তারপরও পুতিনকে সমমর্যাদা দিয়ে তিনি এক কঠিন সত্য স্বীকার করেছেন। আর তাহলো, যুদ্ধ কখনো শত্রুকে অপমান করে থামে না, বরং উভয় পক্ষ যখন লাভের সম্ভাবনা দেখে তখনই থামে। পুতিনের জন্য কূটনীতি - সময় ও বৈধতা আনে, আর ট্রাম্পের জন্য গৌরব। কিন্তু ইউক্রেন ও ইউরোপ কি এ আলোচনার মূল্য খুঁজে পাবে? সে প্রশ্ন রয়ে যায়।
ট্রাম্পের নিজস্ব রেকর্ডও এই ছবিকে জটিল করে তোলে। তিনি যুদ্ধ প্রতিরোধের সাফল্য নিয়ে গর্ব করলেও, তার কূটনৈতিক পদক্ষেপ গুলো মিশ্র। গাজা সংকটে তার নীতি আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকদের মতে, তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর নির্মম অভিযানকে উৎসাহ দিয়েছেন, যার ফলে গাজা আজ মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। যদি সত্যিই তিনি নোবেল-যোগ্য শান্তিদূত হতে চান, তবে সমালোচকরা বলেন—গাজায় রক্তপাত থামাতে মার্কিন প্রভাব খাটিয়েই তিনি শুরু করতে পারেন।
তবুও ট্রাম্পের আলোচনায় বসার প্রবণতাকে একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। কূটনীতি বন্ধুত্বের সঙ্গে নয়, প্রতিপক্ষের সঙ্গেই হয়। রিগ্যান গর্ভাচেভের সঙ্গে বসেছিলেন, নিক্সন মাওয়ের সঙ্গে, এমনকি রুজভেল্ট হিটলারকে পরাজিত করতে স্টালিনের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন। ইতিহাস শেখায়, অনিচ্ছুক সম্মানও শান্তির পূর্বশর্ত। ট্রাম্প–পুতিনের পারস্পরিক স্বীকৃতি হয়তো সরলতা নয়, বরং আস্থা পরীক্ষার প্রাথমিক ধাপ।
তবে সতর্কতা জরুরি। ইউক্রেনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া যে কোনো মার্কিন–রাশিয়া “সমঝোতা” জন্মের আগেই মৃতপ্রায় হবে। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া অস্ত্রবিরতির স্থায়িত্ব বিরল। ১৯৫৩ সালের কোরীয় অস্ত্রবিরতি সাত দশক পরও এক “হিমায়িত সংঘাত।” সিরিয়াতেও অস্ত্রবিরতি হয়েছে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান আসেনি। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের দাবি তাই কেবল বক্তৃতা নয়, ইতিহাসের কঠিন শিক্ষা।
অতএব আলাস্কা বৈঠককে বিচার করতে হবে তার তাৎক্ষণিক ফলাফল দিয়ে নয়, বরং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ভিত্তিতে। যদি এটি কিয়েভকেও আলোচনায় আনার ভূমিকা রাখে, তবে রেইকিয়াভিকের মতো এক সতর্ক বাঁকবদল হিসেবে স্মরণীয় হতে পারে। আর যদি এটি ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে চুক্তি তৈরির প্রচেষ্টা হয়, তবে তা মিউনিখের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে উঠবে।
এখনও যুদ্ধ চলছে। বৈঠকের দিনই ইউক্রেনীয় ড্রোনে রাশিয়ার শহরগুলো কেঁপে ওঠে, সাইরেন বেজে ওঠে পূর্ব ইউক্রেন জুড়ে। প্রতীকী অঙ্গভঙ্গি সত্ত্বেও মস্কো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের দৃঢ় সমর্থনে জেলেনস্কি জমি ছাড়তে অস্বীকৃত।
ট্রাম্পের আলাস্কা উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত হয়তো প্রজ্ঞার প্রমাণ হবে, হয়তো অকাল প্রয়াস। যদি তিনি এটিকে এমন কাঠামোয় রূপ দিতে পারেন যেখানে ইউক্রেন, রাশিয়া, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র একত্রে বসতে পারে, তবে ইতিহাস হয়তো তাকে কেবল প্রদর্শনীর মানুষ নয়, বরং বাস্তব শান্তিনেতা হিসেবে মূল্যায়ন করবে। যদি না পারেন, তবে আলাস্কা সম্মেলন কেবল আরেকটি কূটনৈতিক মরীচিকা হয়ে থাকবে—মঞ্চায়নে বিশাল, কিন্তু সারবস্তুতে শূন্য।
ঝুঁকির মাত্রা এর চেয়ে বেশি আর হতে পারে না। এখানে ঝুলে আছে শুধু ইউক্রেনের ভাগ্যই নয়, বরং কূটনীতির বিশ্বাসযোগ্যতাও। এমন এক সময়ে, যখন যুদ্ধসমূহ ক্রমেই আলোচনার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখনও বিশ্ব প্রমাণ খুঁজছে—গভীর, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নীতিনিষ্ঠ সংলাপ আসলেই সম্ভব কি না?
লেখক : প্রাবন্ধিক ।
এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :
১. দৈনিক সংবাদ, ঢাকা : ১৯ আগষ্ট, ২৫
No comments:
Post a Comment