এম এ হোসাইন,
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে 'বিশেষ সামরিক অভিযান' ঘোষণা করেন, তখন থেকেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধারণা গুরুত্ব পেতে শুরু করে। প্রাথমিকভাবে এটি একটি দ্রুত এবং সুনির্দিষ্ট অভিযান হিসেবে বিবেচিত হলেও, এই সংঘাতটি একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে এবং এর উল্লেখযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছে। রাশিয়ার জন্য পরিস্থিতির জটিলতা এবং ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর শক্তিশালী সমর্থন, বিশ্বকে একটি নতুন বৈশ্বিক সংঘাতের যুগে প্রবেশ করার সম্ভাবনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই ধারণাটি আরও তীব্র হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি অবনতির মাধ্যমে, বিশেষ করে তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে। তাই, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলের সংঘাত, পরাশক্তি দেশগুলোর ভূমিকা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আমরা হয়তো একটি নতুন বিশ্ব যুদ্ধের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে অনেকেই সম্ভাব্য বৈশ্বিক যুদ্ধের প্রথম ধাপ বা "প্রথম ফ্রন্ট" হিসেবে বিবেচনা করেন। যখন রাশিয়া সামরিক অভিযান শুরু করে, তখন সাধারণ ধারণা ছিল এটি একটি সীমিত আঞ্চলিক যুদ্ধ হবে, যার উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনকে দ্রুত দমন করে রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসা। কিন্তু ইউক্রেনের অপ্রত্যাশিতভাবে কঠোর প্রতিরোধ এবং পশ্চিমাদের ব্যাপক সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা এই সংঘাতকে আরও দীর্ঘ এবং জটিল করে তুলেছে।
এই সংঘাতে পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিশেষ করে ন্যাটো দেশগুলোর জড়িত হওয়ায় যুদ্ধের সময়কাল বৃদ্ধি করেছে এবং এটিকে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে একটি প্রক্সি যুদ্ধের রূপ দিয়েছে। এই প্রক্রিয়ার ফলে শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতি, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক সম্পর্কেও বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট জ্বালানি সংকট, বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এর সরাসরি ফলাফল।
ইউক্রেন পশ্চিমাদের সহায়তায় কিছু অগ্রগতি করলেও রাশিয়া পিছু হটছে না। উভয় পক্ষের প্রচণ্ড বিনিয়োগ থাকার কারণে কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি এই সংঘাতকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে, যা শুধু ইউরোপ নয় বরং পুরো বিশ্বের জন্য একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
০৭ ই অক্টোবর ২০২৩, বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করল একটি নতুন সংঘাত, যা অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে "দ্বিতীয় ফ্রন্ট" হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গাজার স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে বিধ্বংসী আক্রমণ চালায়, যার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। এই সংঘাত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ফ্রন্ট খোলার কারণে। ইসরায়েল এখন একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করছে, এবং পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে।
এই ফ্রন্টকে আরও বিপজ্জনক করে তুলতে পারে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা। ইরান, যা হামাস, হিজবুল্লাহ এবং হুথিদের প্রধান সমর্থক, দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করে আসছে। এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। যদি গাজা, ইয়েমেন এবং লেবাননের সংঘাত আরও তীব্র হয়, তবে এটি মিশর, তুরস্ক ও সৌদি আরবের মতো অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারে।
ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় সমর্থন এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সামরিকভাবে জড়িয়ে ফেলতে পারে। এর ফলে বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে যদি ইরান সরাসরি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা অন্যতম ভয়াবহ কারণ হলো রাশিয়া এবং চীনের সাথে ইরানের কৌশলগত সামরিক চুক্তি রয়েছে। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা আক্রান্ত হলে রাশিয়া এবং চীন সকল প্রকার সামরিক সহায়তা দিবে। এছাড়াও, উভয় দেশের পারমাণবিক সক্ষমতা রয়েছে এবং একটি পারমাণবিক সংঘাত বিশ্বের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের প্রভাব শুধুমাত্র আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিকও বটে। এই অঞ্চলটি বৈশ্বিক তেলের সরবরাহের একটি প্রধান কেন্দ্র। যদি যুদ্ধ চলতে থাকে, তবে তা বিশ্ব অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। ১৯৭০-এর দশকের তেল সংকটের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যা বৈশ্বিক মন্দার কারণ হয়ে উঠতে পারে এবং বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
যদিও প্রথম ও দ্বিতীয় ফ্রন্ট বর্তমানে বৈশ্বিক উত্তেজনার সবচেয়ে দৃশ্যমান তবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি 'তৃতীয় ফ্রন্ট' এর সম্ভাবনা খুবই আসন্ন। ওয়াশিংটনের ডিপ-স্টেট নীতিনির্ধারকরা এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরির জন্য একাধিক কার্যক্রম চালাতে পারে। চীন এবং তাইওয়ানের মধ্যে পরিস্থিতি কয়েক দশক ধরেই তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বেইজিংয়ের বক্তব্য ক্রমশ দৃঢ় হয়েছে। চীনা নেতৃত্ব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা প্রয়োজনে তাইওয়ানকে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে বলপ্রয়োগ করতে প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্র, তাদের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, তাইওয়ানের জন্য 'কৌশলগত অস্পষ্টতা' নীতি বজায় রেখেছে। ওয়াশিংটন দ্বীপটিকে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে কিন্তু এর স্বাধীনতাকে সরাসরি স্বীকৃতি দেয় না। তবে, ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি এবং জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে জোট জোরদার করার প্রচেষ্টা ওয়াশিংটনকে তাইওয়ান নিয়ে চীনের সাথে সংঘাতের জন্য প্রস্তুতিরই অংশ মনে হয়।
হংকং, থাইল্যান্ডের ছাত্র আন্দোলনের পর, বাংলাদেশ, ভারত, কাশ্মির এবং পাকিস্তানে অনুরূপ বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। এটা স্পষ্ট যে এই ঘটনার পেছনে আমেরিকান সিআইএ মডেল ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় এজেন্ডার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থান, যা বাংলাদেশের সরকারের দ্রুত পতন এবং পরবর্তীতে প্রো-আমেরিকান অস্থায়ী সরকারের উত্থানই সুস্পষ্ট করেছে। এই পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য হল বাংলাদেশে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চীনকে একাধিক ফ্রন্ট থেকে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ তৈরি করা। এছাড়াও, এই পদক্ষেপটি ভারতের অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দমাতে সহায়তা করবে। ভারতের নৌবাহিনীর ভারত মহাসাগরে শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে। ফলশ্রুতিতে, ভবিষ্যতে আমরা মার্কিন ইন্ধনে কাশ্মির, ভারত, মিয়ানমার এবং তাইওয়ানে সশস্ত্র সংঘাত দেখতে পারি। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চল তথা আরাকান, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল এবং ভারতের মণিপুরকে একত্রিত করে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে, আমেরিকা হংকং, তাইওয়ান, মিয়ানমার, কাশ্মির এবং ভারত জুড়ে সংঘাত উস্কে দিতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত তার স্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক করিডোরের পথ প্রশস্ত করবে।
চীন এখন বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভারতও দ্রুত একটি উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসছে, যার ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপি $১০ ট্রিলিয়নে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। চীন এবং ভারত উভয়ই বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা বাজারের আবাসস্থল। যখন মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ চলমান, তখন ভারত ভবিষ্যতে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় কৌশলকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এই সম্ভাবনাটি সাম্প্রতিক জি-২০ সম্মেলনে উন্মোচিত হয়েছে। তাছাড়া, রাশিয়া-চীন জোটের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থানএটাই ইঙ্গিত দেয় যে ভারত সম্ভবত মার্কিন স্বার্থ গুলো পুরোপুরি মেনে চলবে না। এই পরিস্থিতিতে, যে সুপারপাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অংশ -বাংলাদেশ এর উপর প্রভাব অর্জন করবে, তারাই দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপর কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ অর্জন করবে। বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠা করার ফলে একটি সুপারপাওয়ারের জন্য বিস্তৃত ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বজায় রাখার সক্ষমতা বাড়বে।
এই সব সংঘাতগুলো একত্রে বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যেখানে একটি নতুন বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। এই সংঘাতগুলোর আন্তঃসম্পর্ক এবং শক্তিশালী দেশগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে এবং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার জন্য একটি বৃহত্তর চ্যালেঞ্জের দিকে ইঙ্গিত করে।
এই সংঘাতগুলির অর্থনৈতিক প্রভাব উপেক্ষা করা যাবে না। ইউক্রেনের যুদ্ধ ইতিমধ্যেই একটি বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট সৃষ্টি করেছে, এবং ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরে সংঘাত বৈশ্বিক বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটাবে এবং একটি গুরুতর অর্থনৈতিক মন্দার দিকে নিয়ে যাবে। সাইবার যুদ্ধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য অ-সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে, যার ফলে এই ঘটনাগুলি কীভাবে উদ্ভাসিত হবে তা পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা ক্রমশ বাস্তবতার দিকে ধাবিত হচ্ছে, কারণ বৈশ্বিক রাজনীতির জটিলতা এবং আঞ্চলিক সংঘাতগুলো ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উত্তেজনা—এসবই একে অপরের সাথে সংযুক্ত এবং বৈশ্বিক শক্তির দ্বন্দ্বকে ত্বরান্বিত করছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি, জ্বালানি নিরাপত্তা, এবং সামরিক উত্তেজনা সবই পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল, যা একটি বিস্তৃত সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবে, এখনো সময় আছে কূটনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে এই সংঘাতগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়ক ভূমিকা এবং কার্যকরী কূটনীতির গৃহীত সিদ্ধান্তগুলিই নির্ধারণ করবে যে আমরা আরেকটি বিধ্বংসী বিশ্ব যুদ্ধে থেকে রক্ষা পেতে পারি কিনা?
This article published at :
1. দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ :১০ সেপ্টেম্বর, ২৪
No comments:
Post a Comment