এম এ হোসাইন,
অতিসম্প্রতি লেবাননে হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত হাজার হাজার পেজার ও যোগাযোগের ডিভাইস বিস্ফোরণ এক ভয়ঙ্কর ও উদ্বেগজনক প্রযুক্তিগত যুদ্ধের সূচনা করেছে, যার পিছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার ইংগিত পাওয়া যাচ্ছে। এই বিস্ফোরণগুলি ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে আসন্ন সামরিক সংঘাতের আভাস দিচ্ছে, যা ইতিমধ্যেই উত্তেজনার পটভূমিতে বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থায় রয়েছে। এই উত্তেজনা মূলত গাজার ওপর ইসরায়েলের সামরিক তৎপরতার প্রতিক্রিয়ায় হিজবুল্লাহর প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের কারণে ক্রমশ বাড়ছে। ইসরায়েল গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে কঠোর সামরিক অভিযান পরিচালনার পর, হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলও পরস্পরের বিরুদ্ধে সীমিত আকারে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে, যার ফলে লেবাননের পেজার ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বিস্ফোরণের মতো জটিল ও ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে।
হিজবুল্লাহর অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে লক্ষ্যবস্তু করে এই পেজার ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আক্রমণ চালানো হয়েছে, যা এই অরাষ্ট্রীয় মিলিশিয়ার সামরিক কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দীর্ঘদিন ধরে হিজবুল্লাহ মোবাইল ফোনের পরিবর্তে পেজার ব্যবহার করছে, কারণ তারা সন্দেহ করেছিল যে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থা হ্যাক করে নিয়ন্ত্রণ করছে। কারন, হিজবুল্লাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ইসরায়েলি হামলার শিকার হয়েছিল। এই অবস্থায় যোগাযোগের নেটওয়ার্কে আক্রমণ করে, ইসরায়েল সম্ভবত হিজবুল্লাহর নতুন দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে চাইছে। এর মাধ্যমে তারা হিজবুল্লাহর যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল করতে এবং সামরিক সংঘাতের সময় তাদের কার্যক্রম ব্যাহত করতে চায়। এই পদক্ষেপটি ইসরায়েলের বৃহত্তর কৌশলের একটি অংশ, যার মূল লক্ষ্য হলো হিজবুল্লাহর প্রভাব নিরসন করা এবং একইসাথে হিজবুল্লাহের বিরুদ্ধে অভিযানকে আরও কার্যকরী করা।
হিজবুল্লাহর সাম্প্রতিক যোগাযোগের কৌশলটি তখনই একটি বিপজ্জনক মোড় নিয়েছিল যখন এটি প্রকাশিত হয়েছিল যে, এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীর পেজারগুলি তাইওয়ানের প্রস্তুতকারক গোল্ড অ্যাপোলোর কাছ থেকে অর্ডার করা হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, এই ৫,০০০ পেজার লেবাননে পৌঁছার পূর্বেই ডিভাইস গুলোতে অল্প পরিমাণে বিস্ফোরক আরডিএক্স (হেক্সোজেন) বসিয়েছে। বেশিরভাগ ডিভাইসই ছিল AR-924 মডেলের। কথিত এই তিন গ্রামের কম বিস্ফোরক প্রতিটি পেজারে ব্যাটারির পাশে কৌশলগতভাবে রাখা হয়েছিল। একটি রিমোট-ট্রিগার সুইচও জুড়ে দেয়া হয়েছিল, যা পেজারগুলির বিস্ফোরণে সাহায্য করেছে। এই বিস্ফোরণে প্রাথমিকভাবে নয়জন নিহত এবং প্রায় ২,৮০০ জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক, ফলে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ওয়াকি টকি বিস্ফোরণে কমপক্ষে ২০ জন নিহত ও ৪৫০ জনের মত আহত হয়েছেন। তবে এই বিস্ফোরণের প্রভাব আরও গভীর এবং দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। লেবাননের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ইতিমধ্যেই সংকটে রয়েছে। এই ধরনের বিস্ফোরণের ফলে যদি ইসরায়েল পূর্ণাঙ্গ সামরিক আক্রমণ চালায়, তবে লেবাননের স্বাস্থ্যব্যবস্থা চরম সংকটে পড়তে পারে। বিশেষ করে সামরিক ও বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা দিতে সমস্যা দেখা দেবে। আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসা করাও কঠিন হয়ে উঠবে, যার ফলে মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে। বেসামরিক মানুষের ওপর এর প্রভাব হবে সবচেয়ে বেশি, কারণ যুদ্ধকালীন সময়ে চিকিৎসা সুবিধার অভাব তাদের জীবনের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
ইলেকট্রনিক ডিভাইস বিস্ফোরণের ঘটনাটি প্রমাণ করে যে আধুনিক যুদ্ধে প্রযুক্তির ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অপ্রথাগত সামরিক কৌশল ব্যবহার করে, ইসরায়েল হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করতে চাইছে। যোগাযোগ নেটওয়ার্কের উপর আঘাত হানার মাধ্যমে তারা ভবিষ্যতে স্থল বা আকাশপথে আক্রমণের ক্ষেত্রে নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করতে চায়। প্রযুক্তিগত আক্রমণের এই কৌশলটি শুধু সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, বরং হিজবুল্লাহর সামগ্রিক কার্যক্রমকেও দুর্বল করতে পারে।
এ সংঘাত শুধু সামরিক দিক থেকে নয়, আঞ্চলিক রাজনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। হিজবুল্লাহ ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইরান দীর্ঘদিন ধরে হিজবুল্লাহকে সমর্থন দিয়ে আসছে, এবং এই সমর্থনের মাধ্যমে হিজবুল্লাহ তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি বজায় রেখেছে। তবে ইরান এই সংঘাতে সরাসরি জড়িত না হলেও, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আক্রমণকে ইরান নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে দেখছে। যদি সংঘাত আরও বৃদ্ধি পায়, তাহলে ইরান এতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় আঞ্চলিক যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। এই যুদ্ধের পরিণাম শুধু ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্য তথা বৈশ্বিক সংঘাতেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
ইসরায়েল হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই এ সংঘাতকে আরও উস্কে দিচ্ছে। ইসরায়েল সম্প্রতি সিরিয়ায় ইরানি স্থাপনা, বিশেষত দামেস্কে ইরানের মিশন লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে। এছাড়াও ইসরায়েল ইরানে হামাসের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের হত্যা করেছে। এসব কার্যক্রম ইসরায়েলের বৃহত্তর কৌশলের অংশ, যার মাধ্যমে তারা ইরানের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইছে। ইসরায়েল ইরানকে একটি বড় আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দেখে, এবং তাদের কৌশলগত লক্ষ্য হলো ইরানের প্রভাবকে কমিয়ে আনা। এই পরিস্থিতিতে, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘাত দ্রুত ইরানকে জড়িয়ে একটি বড় আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো, ইসরায়েলের এই তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো পদক্ষেপ এখনো নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের প্রধান মিত্র, অব্যাহতভাবে ইসরায়েলের সামরিক তৎপরতাকে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে, যদিও গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দা জানানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সমর্থন ইসরায়েলকে আরও উগ্র পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করছে। ইসরায়েল মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকার কারণে তারা তাদের কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য আরও আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিতে পারবে। তাছাড়া, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়ের সম্ভাবনা প্রবল হওয়াতে ইসরায়েল আগেভাগে তার স্ট্র্যাটেজিক টার্গেট গুলো কে দূর্বল করতে চাইছে। এ অবস্থায়, গোটা অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অস্থিতিশীলতা শুধু ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এই সংঘাতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, এটি কীভাবে আরও বিস্তৃত সংঘাতের জন্ম দিতে পারে যা লেবানন ও এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। হিজবুল্লাহ এখনও সীমিত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, সীমান্তে বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করছে। তবে পুরোপুরি যুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। যদি হিজবুল্লাহ মনে করে ইসরায়েলের পদক্ষেপ তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি, তারা হয়তো আরও বড় আকারে প্রতিশোধ নিতে পারে। তাদের আঞ্চলিক মিত্র, বিশেষ করে ইরান, এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে, যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে, কারণ এই সংঘাতের সাথে যুক্ত রয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি, যেমন সিরিয়া, ইরাক, এবং ইরানের সামরিক উপস্থিতি।
এ অবস্থায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। যুদ্ধের বিস্তার রোধ করতে হবে এবং কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে হবে। ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে চলমান উত্তেজনা যদি আরও বাড়তে থাকে, তাহলে এটি একটি বড় ধরনের আঞ্চলিক সংঘাতেরই জন্ম দেবে না তা আমাদেরকে আরেকটি তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিবে। আমরা কি সেই অত্যন্ত ভয়াবহ পরিণতি অনুধাবন করতে পারছি?
লেখক একজন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
This article published at :
1. Daily Ittefaq, BD : 20 Sep, 24
2. Daily Sangbad, BD : 26 Sep, 24
No comments:
Post a Comment