এম এ হোসাইন,
গত ০৪ ফেব্রুয়ারি,২০২৫,হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে, গাজা সম্পর্কিত এক অভাবনীয় ও বিতর্কিত পরিকল্পনার ঘোষণা দেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র গাজা ভূখণ্ড “নিয়ন্ত্রণে নেবে”, ১৮ লাখ ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করবে এবং অঞ্চলটিকে বিলাসবহুল আবাসিক এলাকায় রূপান্তর করবে, যা হবে “মধ্যপ্রাচ্যের সুন্দর উপকূলীয় অঞ্চল”। এই পরিকল্পনা মানবিক সংকটের সমাধান হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও, এটি আসলে সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারা, ভূরাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মিশ্রণ। ট্রাম্প দাবি করেন, তার পরিকল্পনা “স্থিতিশীলতা” ও “অগণিত কর্মসংস্থান” সৃষ্টি করবে। কিন্তু এটি বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় তুলেছে এবং ঔপনিবেশিকতা ও জাতিগত নির্মূলের (ethnic cleansing) সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। বাস্তবে এই পরিকল্পনা অকার্যকর ও নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির গতিপথ সম্পর্কেও গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
ট্রাম্প, তার রিয়েল এস্টেটের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, গাজাকে কেবল ধ্বংসাবশেষে পরিণত একটি “বিনির্মাণযোগ্য অঞ্চল” হিসেবে দেখছেন। তার কল্পনায়, মার্কিন সেনারা সেখানে অবিস্ফোরিত গোলাবারুদ পরিষ্কার করবে, ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন ভেঙে ফেলবে এবং ভূমধ্যসাগরের তীরে বিলাসবহুল আবাসন ও রিসোর্ট নির্মাণ করবে। ফিলিস্তিনিদেরকে তিনি মিশর ও জর্ডানে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যেখানে তারা “শান্তিপূর্ণ ও উন্নত পরিবেশে” বসবাস করতে পারবে বলে তার দাবি।
এই পরিকল্পনার মূল ধারণাটি নতুন নয়। ২০১৯ সালে ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার গাজার সমুদ্রতটকে “অত্যন্ত মূল্যবান” বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং সেখানে নতুন অবকাঠামো তৈরির জন্য ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। এবার ট্রাম্প আরও একধাপ এগিয়ে এটিকে “মানবিক উদ্যোগ” হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। “তারা ভালো মানের বাড়িতে থাকবে… যেখানে তাদের মৃত্যু হবে না।” কিন্তু ট্রাম্প এড়িয়ে গেছেন যে গাজার সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক শতাব্দী-প্রাচীন। একজন সাংবাদিক যখন তাকে প্রশ্ন করেন—“কিন্তু এটি তাদের জন্মভূমি, তারা কেন ছাড়বে?”—ট্রাম্প সংক্ষেপে বলেন, “এই জায়গাটা নরকসম।”
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থীদের দীর্ঘদিনের এজেন্ডার সঙ্গে মিলে গেছে। জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির, যিনি বরাবর ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের পক্ষে ছিলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে “একটি সুন্দর বন্ধুত্বের সূচনা” বলে প্রশংসা করেছেন। অন্যদিকে, নেতানিয়াহু এটিকে “গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রস্তাব” হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা গাজাকে “নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি” থেকে মুক্ত করার সুযোগ এনে দেবে।
তবে আরব বিশ্ব দ্রুত এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে। সৌদি আরব পুনরায় তার “দৃঢ় ও অপরিবর্তনীয়” ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির কথা জানিয়ে দিয়েছে। মিশর ও জর্ডান—দুটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন মিত্র—ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদকে “অস্তিত্বের জন্য হুমকি” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি সরাসরি বলেছেন, “জর্ডান জর্ডানিয়ানদের জন্য, আর ফিলিস্তিন ফিলিস্তিনিদের জন্য।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি—দুই-রাষ্ট্র নীতিকে (two-state solution) ধ্বংস করবে। যদি মার্কিন প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের গণ-উচ্ছেদ সমর্থন করে, তাহলে ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থীরা গাজা ও পশ্চিম তীর সংযুক্ত করার (annexation) বৈধতা পাবে, যা ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের (self-determination) পথ আরও সংকুচিত করবে।
গাজার ৯০% জনগণ ইতোমধ্যেই বাস্তুচ্যুত, এবং ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলমান ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের কারণে ৪৬,৬০০ মানুষ নিহত হয়েছে। এখন তাদের বাধ্যতামূলকভাবে উচ্ছেদ করা হলে, এটি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করবে এবং জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী জাতিগত নির্মূলের শামিল হবে। ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন কংগ্রেসওম্যান রাশিদা তালিব ট্রাম্পের ঘোষণাকে সরাসরি “জাতিগত নির্মূলের আহ্বান” বলে আখ্যা দিয়েছেন।
ট্রাম্পের পরিকল্পনার ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট। গাজাকে “ফাঁকা জমি” হিসেবে দেখে সেখানে মার্কিন নেতৃত্বে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখা, এক শতাব্দী আগে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যপ্রাচ্যের ভাগাভাগির (Sykes-Picot Agreement) স্মৃতি উসকে দেয়, যার পরিণতি আজও চলছে। তার “দীর্ঘমেয়াদী মালিকানা” (long-term ownership) নেওয়ার ধারণা ঊনবিংশ শতকের সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের মতোই শোনায়, যা আধুনিক কূটনীতির পরিপন্থী।
ট্রাম্পের সমর্থকরা বলছেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যকে নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করছেন। তার লক্ষ্য হলো আব্রাহাম অ্যাকর্ডকে দৃঢ় করা এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের জন্য একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। তাছাড়া ট্রাম্প সারা বিশ্বকে দেখাতে চান তিনি তার সিদ্ধান্ত গ্রহনে সচরাচর দৃষ্টিভঙ্গি না রেখে অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন। তিনি সম্ভবত তার মতো করে দ্বিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। সেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে পশ্চিমা পন্থী, ইসরাইলের সাথে নতজানু হয়ে চলা এবং সকল ধরনের সশস্ত্র সংগঠন মুক্ত, যারা ভবিষ্যতে ইজরাইলের জন্য হুমকি স্বরূপ হতে পারে। তিনি মূলত হামাসকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে এবং এঅঞ্চলে ইরানের প্রভাব নিষ্ক্রিয় করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঘোষণা দিবেন।
গাজায় মার্কিন সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে তিনি ইরান ও লেবাননের ওপর নজরদারি জোরদার করতে চান। যদি তিনি গাজায় প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, তবে তার পরবর্তী লক্ষ্য হবে লেবানন, যেখানে তিনি হিজবুল্লাহকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে একটি গনতান্ত্রিক ও পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট সরকার গঠন করতে চান। তবে, এসকল ক্ষেত্রে দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও চীন উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিরোধ করবে বলে মনে হয় না। ট্রাম্প মূলত ইরানের কৌশলগত সামরিক প্রক্সি বাহিনীর প্রভাব এবং অবস্থান দুটোই ধ্বংস করে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব নিষ্ক্রিয় করে দেবে। তারপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে হয়তোবা তেহরানের শাসন পরিবর্তন করার চেষ্টা করবে। এটা নিশ্চিত যে, ইসরায়েল তার নিরাপত্তা হুমকির বিরুদ্ধে বেশ শক্ত অবস্থান করে ফেলেছে ০৭ সেপ্টেম্বর বিপর্যয়ের পর। যেমন দেখা গেছে, পেজার বিস্ফোরণ কিংবা হামাস, হিজবুল্লার প্রধান কে ইরানের মাটিতে সুরক্ষিত অবস্থায় তাদের কে হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু অপরপক্ষে বাস্তবতা আরও কঠিন। গাজা সহজেই আরেকটি আফগানিস্তানে পরিণত হতে পারে, কারণ ইরান দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মীয় প্রভাবের আড়ালে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে আঞ্চলিক সক্ষমতা বিস্তার করছে। কিন্তু যদি ট্রাম্প তার এই গাজা দখল নীতির বাস্তবায়ন করেন তবে তা শুধু ধর্মীয় রূপ নিতে বেশি সময় লাগবে না। ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতি হয়তো উল্টো আরব মুসলিমদের মধ্যে জিহাদী মনোভাব উসকে দেবে, যা অঞ্চলে আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যখনই পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যের জাতি গঠনের জন্য অনুপ্রবেশ করেছে তার পরিণতি কখনোই ভালো হয়নি। ইরাক যুদ্ধ থেকে শুরু করে লিবিয়ান হস্তক্ষেপ পর্যন্ত, আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা বিশৃঙ্খলা, উগ্রপন্থা এবং প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ট্রাম্পের সেই পরামর্শ যে গাজা একটি “আন্তর্জাতিক শহর” হিসেবে মার্কিন নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে যেমন তার পূর্বের চিন্তা ছিল গ্রিনল্যান্ড বা পানামা খাল সংযুক্ত করার বিষয়ে। এগুলো মূলত আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতি উদ্বেগজনক এক ধরনের মোহকে প্রকাশ করে।
ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। আরব রাষ্ট্রগুলোর কঠোর বিরোধিতা, আন্তর্জাতিক আইনের বিধিনিষেধ, এবং মার্কিন জনমতের অনীহা—এসব বিবেচনায় এটি প্রায় অসম্ভব। তবে ট্রাম্প তার চিরাচরিত কৌশলে এগোচ্ছেন: উচ্চাভিলাষী, অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব দিয়ে আলোচনার টেবিলে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করা। এটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের সাধারণ পদ্ধতি—প্রাথমিকভাবে অত্যন্ত উচ্চমূল্যের দাবি তোলা, যাতে দর-কষাকষিতে সুবিধা পাওয়া যায়।
তবে আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসা এক নয়। গাজা কোনো “ধ্বংসস্তুপ” নয়, বরং একটি আবাসভূমি—যেখানে দুঃখ আছে, কিন্তু দৃঢ়তা ও ঐতিহ্যও রয়েছে। যুগের পর যুগ গাজাবাসীরা একটি শক্তিশালী এবং অসম আগ্রাসী দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। এটা নীতি হীন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আদর্শিক ও মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। এ লড়াইয়ের সমাপ্তি কি হয় হয়তোবা মার্কিন জনগণের অতীতে বেশ তিক্ততার অভিজ্ঞতা আছে। কাজেই, ট্রাম্পের উসকানিমূলক প্রস্তাব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য আরেকটি সতর্কবার্তা। টেকসই শান্তি কখনো জোরপূর্বক উচ্ছেদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :
১. দৈনিক সংবাদ, বাংলাদেশ : ০৭ ফেব্রুয়ারী, ২৫
২. যায় যায় দিন, বাংলাদেশ, ০৮ ফেব্রুয়ারী, ২৫
No comments:
Post a Comment