এম এ হোসাইন,
কূটনীতি এক ধরনের দাবার খেলা—এখানে প্রয়োজন আগাম পরিকল্পনা, অবস্থান নির্ধারণ ও কৌশলগত প্রভাব বিস্তার। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের বহুল প্রতীক্ষিত চীন সফর ঘিরে নীতি-নির্ধারণী মহলে এখন প্রশ্ন উঠছে—এই সফর কি নিছক রাষ্ট্রীয় সৌজন্যের অংশ, নাকি এর গভীরে রয়েছে আরও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা? বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সফরকে আরও রহস্যময় করে তুলেছেন, ইঙ্গিত দিয়েছেন যে সফর শেষে একটি “গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা” আসতে পারে। তবে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি ধোঁয়াশা রেখে বলেন, “অপেক্ষা করুন, এখনো কাজ চলছে।” চীনা কূটনীতির এই ধরনের অস্পষ্টতা নতুন কিছু নয়; বরং এটি আরও প্রশ্নের জন্ম দেয়—আসলে আলোচনার টেবিলে কী রয়েছে?
পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসাইন অবশ্য প্রত্যাশা কমিয়ে বলেছেন, এই সফরে কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হবে না, কেবল কয়েকটি সমঝোতা স্মারক (MoU) সই হবে। কিন্তু ভূরাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে সমঝোতা স্মারক অনেক সময়ই গভীর কৌশলগত সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত, এই সফরের মাত্র এক সপ্তাহ পরই ড. ইউনুসের ভারত সফর এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক রয়েছে, যা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে বাংলাদেশ দুই আঞ্চলিক পরাশক্তির মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করছে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই সফর?
ড. ইউনুসের চীন সফর সাধারণ কোনো উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক বিনিময় নয়। এটি এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন দক্ষিণ এশিয়ায় বেইজিংয়ের কৌশলগত স্বার্থ দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে এবং বাংলাদেশ এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সফরটি এমন সময় হচ্ছে যখন বোআও ফোরাম ফর এশিয়া (এশিয়ার দাভোস নামে পরিচিত) অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যেখানে বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট ও রাজনৈতিক নেতারা মিলিত হন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে ড. ইউনুসের এই ফোরামে অংশগ্রহণ চীনের বাংলাদেশের প্রতি বিশেষ আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশে চীনের কৌশলগত স্বার্থ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। চীন এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী এবং প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। এছাড়া, চীনের বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প, বিশেষত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর আওতায় বিদ্যুৎ, পরিবহন ও সংযোগ প্রকল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে।
তবে চীনের আকাঙ্ক্ষা শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশকে একটি কৌশলগত খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করে বেইজিং, যা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব মোকাবিলার বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। অন্যদিকে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মাধ্যমে চীনকে প্রতিহত করতে চাইছে, ফলে বেইজিংয়ের ঢাকা-সংযোগ অর্থনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোর ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
এই আলোচনায় যে বিষয়টি সামনে আসতে পারে তা হলো তিস্তা নদী প্রকল্প। চীন এই প্রকল্পে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য জলসম্পদ নিরাপত্তার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ভারত এই উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখছে, কারণ দিল্লি দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের অর্থায়নকৃত প্রকল্পগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশ যদি এই প্রকল্পে চীনের সহযোগিতায় এগিয়ে যায়, তবে তা আঞ্চলিক জলনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে এবং ভারতীয় কৌশলবিদরা এ নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণে রাখবে ।
রোহিঙ্গা সংকট: বেইজিংয়ের প্রভাব কীভাবে কাজে লাগানো যায়?
অবকাঠামো ও বাণিজ্যের বাইরেও, বাংলাদেশের জন্য চীনের কার্যকর সহযোগিতা প্রয়োজন এমন একটি প্রধান ক্ষেত্র হলো রোহিঙ্গা সংকট। ২০১৭ সাল থেকে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের কাঁধে বোঝা হয়ে আছে, অথচ এর কোনো টেকসই সমাধান এখনো দেখা যাচ্ছে না। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের জন্য ঢাকা বারবার আহ্বান জানালেও অগ্রগতি সামান্যই হয়েছে।
মিয়ানমারের সবচেয়ে প্রভাবশালী মিত্র হিসেবে চীনের নেইপিদোর সামরিক জান্তার ওপর উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অতীতে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যত প্রতীকী পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থেকেছে। তবে আসন্ন সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এবার চীনের প্রতি আরও “গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ ভূমিকা” পালনের আহ্বান জানাতে পারে।
এই ইস্যুতে চীনের অবস্থান জটিল। যদিও বেইজিং মাঝে মাঝে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলেছে, তবে তাদের মূল আগ্রহ মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, যেখানে তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে—বিশেষত জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে। তাই মিয়ানমারের ওপর বাস্তবিক চাপ প্রয়োগের সম্ভাবনা সীমিত হলেও, বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে আরও কার্যকর ভূমিকার প্রত্যাশা করবে।
অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা: শুল্কমুক্ত সুবিধার বাইরে আরও কী সম্ভব?
এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা গভীর করা। যদিও চীন বাংলাদেশের ৯৭% রপ্তানিপণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, এর বাস্তব সুফল এখনো সীমিত। বাংলাদেশের রপ্তানি এখনো মূলত তৈরি পোশাক খাতে কেন্দ্রীভূত, আর চীনের এই খাতে চাহিদা তেমন বেশি নয়, ফলে বাণিজ্য ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি।
এ কারণে ঢাকা চীনের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের ওপর জোর দিতে পারে, বিশেষত উৎপাদনশীল শিল্প ও প্রযুক্তিনির্ভর খাতে। যদি বাংলাদেশ শিল্প উৎপাদন ও মূল্য সংযোজিত রপ্তানি বাড়াতে না পারে, তবে তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগানো সম্ভব হবে না, বরং কম খরচের শ্রমনির্ভর উৎপাদনে আটকে থাকার ঝুঁকি থেকেই যাবে।
অন্যদিকে, চীন বাংলাদেশে তার অর্থনৈতিক উপস্থিতি আরও বিস্তৃত করতে চাইবে, বিশেষ করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ) ও শিল্প করিডোরের মাধ্যমে—যা পাকিস্তানে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)-এর মডেলের অনুরূপ হতে পারে। এসব বিনিয়োগ মূলধন ও কর্মসংস্থান আনবে ঠিকই, তবে একইসঙ্গে ঋণনির্ভরতার ঝুঁকিও বাড়াতে পারে—যা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সামাল দিতে হবে।
ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা: ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী হবে?
ইউনুসের চীন সফর ঘিরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রশ্ন হলো, এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতির কাঠামোয় কীভাবে সংযুক্ত হবে। ঐতিহাসিকভাবে ঢাকা “ভারসাম্যপূর্ণ” কূটনীতির নীতি অনুসরণ করে আসছে—একদিকে চীন ও ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেও সম্পৃক্ত থেকে।
সফরের সময়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ: শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের এক সপ্তাহের মধ্যেই ইউনুস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এই সময়কাল ইঙ্গিত দেয় যে ঢাকা কৌশলগতভাবে নিজেকে এমন এক অবস্থানে রাখতে চাচ্ছে, যেখানে দুই পক্ষ থেকেই অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধা আদায় করা সম্ভব হবে, অথচ কেউই ক্ষুব্ধ হবে না।
ভারত দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধিকে সতর্কতার সঙ্গে দেখছে। ফলে তারা এই সফরকে বেইজিংয়ের বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করতেই পারে। তবে বাংলাদেশ এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যা সরাসরি দিল্লিকে ক্ষুব্ধ করতে পারে। বরং ঢাকা চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ততাকে ভারতের কাছ থেকে আরও অনুকূল বাণিজ্য ও পানিসম্পদ বিষয়ক চুক্তি আদায়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে।
অন্যদিকে, চীনকে প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল জোরদার করছে, ফলে ওয়াশিংটনও ঢাকার গতিবিধির ওপর নজর রাখবে। যদিও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিরাপত্তা সহযোগিতাসহ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা বেড়েছে। তাই ঢাকার চ্যালেঞ্জ হবে বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতায় না জড়িয়ে, বরং সব পক্ষ থেকে বাস্তব সুবিধা আদায় করা।
কৌশলগত তাৎপর্যপূর্ণ সফর
অধ্যাপক ইউনুসের চীন সফর নিছক কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; এটি বাংলাদেশের কৌশলগত বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত—যা আগামী কয়েক বছর ধরে এর ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে। প্রশ্ন হলো, ক্রমশ মেরুকৃত বৈশ্বিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশ নিজেকে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে, যেখানে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত?
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের “ভারসাম্যপূর্ণ” কৌশল ভালোই কাজ করেছে। তবে এই ভারসাম্য বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে উঠবে, কারণ প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে। সফল হতে হলে, বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে দক্ষ কূটনীতি, অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা এবং আঞ্চলিক বাস্তবতাকে গভীরভাবে বোঝার ক্ষমতা।
ড. ইউনুসের চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট: কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে চীনের কাছ থেকে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সুবিধা আদায় করা। তবে তার সফলতা নির্ভর করবে শুধু বেইজিংয়ে কী আলোচনা হয় তার ওপর নয়—বরং বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক দাবার বোর্ডে কীভাবে চাল চালা হয়, তার ওপর।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :
১. দৈনিক আমার দেশ, বাংলাদেশ : ২৯ মার্চ, ২৫
No comments:
Post a Comment