Monday, 10 March 2025

নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপানের বিতর্ক

এম এ হোসাইন


বাংলাদেশে নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করার দাবি একটি বিতর্কিত বিষয়, যা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সামাজিক মূল্যবোধ, জনস্বাস্থ্য এবং রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। সমর্থকরা মনে করেন, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অন্যদিকে, বিরোধীরা এটিকে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও লিঙ্গ সমতার পরিপন্থী হিসেবে দেখেন। এই বিতর্ক কেবল ধূমপানের উপর সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি নৈতিকতা, সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা এবং বাংলাদেশি সমাজে নারীদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার সঙ্গে জড়িত একটি বৃহত্তর প্রশ্ন।


বাংলাদেশের সঙ্গে ধূমপানের সম্পর্ক জটিল। ঐতিহাসিকভাবে, পুরুষদের মধ্যে ধূমপান ব্যাপকভাবে গৃহীত, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে ও বয়স্কদের মধ্যে। তবে, নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান এখনও ব্যাপকভাবে নিন্দিত। যদিও নারীদের ধূমপানের ওপর কোনো আইনগত নিষেধাজ্ঞা নেই, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এটিকে নিরুৎসাহিত করে। ফলে প্রকাশ্যে ধূমপান করা নারীরা প্রায়ই সমালোচনা, নেতিবাচক মন্তব্য বা এমনকি হয়রানির শিকার হন। এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে প্রচলিত গভীর লিঙ্গভিত্তিক নিয়মের প্রতিফলন, যেখানে ধূমপানকে পুরুষদের অভ্যাস হিসেবে দেখা হয়, আর নারীদের ক্ষেত্রে একে বিদ্রোহী বা নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ হিসেবে গণ্য করা হয়।


নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করার পক্ষে যুক্তি হলো— এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রক্ষার জন্য জরুরি। একটি প্রধানত রক্ষণশীল সমাজে, যেখানে প্রচলিত লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা এখনও দৃঢ়ভাবে প্রচলিত, নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান সমাজের প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়। অনেকের মতে, এটি নিষিদ্ধ করা হলে দেশের দীর্ঘদিনের নৈতিক মান বজায় থাকবে এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় ক্ষুন্ন হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এই দাবি জোরালো, কারণ ইসলাম ধূমপান নিরুৎসাহিত করে এবং ধর্মীয় নেতা ও মতবাদে ধূমপানের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখা যায়। ফলে অনেকের কাছে এই নিষেধাজ্ঞা জাতীয় নৈতিকতা বজায় রাখার একটি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত।


এছাড়া, জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত; এটি ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদরোগ এবং শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার মতো প্রতিরোধযোগ্য রোগের প্রধান কারণ। নারী ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেশি, বিশেষত প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। গর্ভাবস্থায় ধূমপান কম ওজনের শিশু জন্ম, অকালপ্রসব এবং শিশুর শারীরিক জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। ফলে, নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হলে ধূমপানের প্রতি নিরুৎসাহিত করা সম্ভব হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যোন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে সমর্থকরা মনে করেন।


যুবসমাজের ওপর প্রভাব এই বিতর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান তরুণীদের কাছে এ অভ্যাসকে স্বাভাবিক করে তুলতে পারে এবং সিগারেটের প্রতি তাদের কৌতূহল বাড়াতে পারে। কৈশোর এমন একটি সময়, যখন ব্যক্তি সহপাঠী ও সমাজের প্রভাবের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল থাকে। এ অবস্থায় নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হলে কিশোরীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা কমানোর একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। অনেকেই যুক্তি দেন যে, যেভাবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপনে বিধিনিষেধ রয়েছে, ঠিক সেভাবেই নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপানের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হলে তরুণীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা কমানো সম্ভব হবে।


এই বিতর্ক বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ভাবমূর্তির সঙ্গেও জড়িত। দেশটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাইছে। এ প্রেক্ষাপটে নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার একটি অংশ হয়ে উঠেছে। অনেকের মতে, নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান যদি সাধারণ চিত্র হয়ে ওঠে, তবে এটি কিছু পর্যটককে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের মতো রক্ষণশীল অঞ্চল থেকে আসা ভ্রমণকারীদের, নিরুৎসাহিত করতে পারে। এসব পর্যটক সাধারণত এমন স্থান বেছে নেন, যা তাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিষেধাজ্ঞার পক্ষে থাকা ব্যক্তিরা মনে করেন, নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপানের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলে বাংলাদেশ তার ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ রক্ষাকারী দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, যা এই ধরনের পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সহায়ক হতে পারে।


অর্থনৈতিক দিকও এই বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তামাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে, হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে এবং সরকারের জন্য বিপুল রাজস্ব আয় নিশ্চিত করে। নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করার বিরোধীরা যুক্তি দেন, এটি বৃহত্তর অ্যান্টি-স্মোকিং (ধূমপান বিরোধী) নীতির পথ খুলে দিতে পারে, যা পুরো শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, সমর্থকরা পাল্টা যুক্তি দেন যে, দীর্ঘমেয়াদে ধূমপানের হার হ্রাসের ফলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় কমে আসবে, যা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশি লাভজনক। তাদের মতে, তামাক শিল্পের ওপর নির্ভর না করে বাংলাদেশকে তার অর্থনীতিকে বহুমুখী করা এবং এমন শিল্পে বিনিয়োগ করা উচিত, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়।


এ বিষয়টির রাজনৈতিক বাস্তবতাও গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিবিদরা সাধারণত জনমতের সঙ্গে নিজেদের অবস্থান মিলিয়ে চলেন, বিশেষত এমন ইস্যুতে যা জনগণের বৃহৎ অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে নারীদের আচরণ নিয়ে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি গভীরভাবে প্রোথিত। ফলে নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করার পক্ষে অবস্থান নেওয়া জনপ্রিয়তার কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে। যেসব নেতা এ ধরনের নীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন, তারা নিজেদের সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধের রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, যা ধর্মীয় ও রক্ষণশীল ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সহায়ক হতে পারে। এছাড়া, নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করার দাবিকে মাঠপর্যায়ের সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলন সমর্থন করে, যা রাজনৈতিক নেতাদের এই বিষয়টিকে আইনগত রূপ দেওয়ার জন্য শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে।


এমন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়া সম্ভব হবে না। এটি প্রয়োগের বড় চ্যালেঞ্জ হলো— প্রকাশ্যে নারীদের ধূমপান নিষিদ্ধ করলে এটি পুরোপুরি বন্ধ না হয়ে বরং গোপনে ধূমপানের প্রবণতা বাড়াতে পারে। পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে নারী ধূমপায়ীরা আরও গোপন স্থানে ধূমপান করতে বাধ্য হতে পারেন, যা তামাক গ্রহণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি করা কঠিন করে তুলবে। অন্যান্য দেশেও দেখা গেছে, কঠোর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ফলে কালোবাজারি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অবৈধভাবে সিগারেট বিক্রির প্রবণতা বেড়েছে।


এছাড়া, নিষেধাজ্ঞার বিরোধীরা একে লিঙ্গভিত্তিক পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করেন। যদি পুরুষরা প্রকাশ্যে বাধাহীনভাবে ধূমপান করতে পারেন, তবে নারীদের জন্য আলাদা নিয়ম কেন থাকবে? অনেকের দৃষ্টিতে এটি জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের চেয়ে পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকে আরও দৃঢ় করার একটি প্রচেষ্টা। যদিও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি নারীদের ধূমপান নিরুৎসাহিত করে, কিন্তু এই রীতিগুলোকে আইন দ্বারা বাধ্যতামূলক করা ব্যক্তিস্বাধীনতা ও লিঙ্গ বৈষম্যের নৈতিক প্রশ্ন তোলে। সমালোচকদের মতে, নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যাতে নারী ও পুরুষ উভয়েই ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারে এবং আইন দ্বারা বাধ্য না হয়ে নিজেরা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।


আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ওপর সম্ভাব্য প্রভাব। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে লিঙ্গসমতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়গুলো ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপানের ওপর সরকার-প্রদত্ত নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টিতে পশ্চাৎপদ সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে ও কর্মসংস্থানে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমে। শুধুমাত্র নারীদের লক্ষ্য করে প্রকাশ্যে ধূমপানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে এই অগ্রগতি ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং দেশকে এমন একটি রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে, যেখানে এখনো নারীদের স্বাধীনতার ওপর অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।


তবে, এসব যুক্তি সত্ত্বেও নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করার আন্দোলন সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা, জনস্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক কৌশলের সমর্থনে এগিয়ে চলছে। শেষ পর্যন্ত এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটা স্পষ্ট যে এই বিতর্ক শুধু ধূমপান নিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব, জননৈতিকতা ও ব্যক্তি অধিকারের সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক কৌশল ও বাস্তব সামাজিক কল্যাণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার বৃহত্তর লড়াইয়ের প্রতিফলন।


সবশেষে, মূল প্রশ্ন থেকে যায়— নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান কি বাংলাদেশের সমাজের জন্য ইতিবাচক না নেতিবাচক প্রভাব ফেলে? জনস্বাস্থ্য ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও, চ্যালেঞ্জ হলো এমন একটি নীতিগত ভারসাম্য খুঁজে বের করা, যা সমাজের মূল্যবোধ ও ব্যক্তি স্বাধীনতা— দুটিকেই সম্মান করে। যদি নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান সমাজের জন্য ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়, তবে বিধিনিষেধ যৌক্তিক হতে পারে। তবে, যে কোনো নীতি বাস্তবায়ন অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত হতে হবে, যাতে এটি লিঙ্গ বৈষম্যকে আরও শক্তিশালী না করে কিংবা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে দমন না করে।


বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধমান সামাজিক পরিবর্তনের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপানের বিতর্ক কেবল তামাক ব্যবহারের প্রসঙ্গ নয়, বরং এটি একটি পরীক্ষা— বাংলাদেশ কেমন সমাজ হতে চায় এবং যা হবে তার আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।


   লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। 


এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে : 

১. দৈনিক সংবাদ, বাংলাদেশ : ১০ মার্চ, ২৫

No comments:

Post a Comment