এম এ হোসাইন,
যে কোন মানদণ্ডে বিচার করলে, নেপালের রাজনৈতিক অঙ্গন কখনোই শান্ত ছিল না। তবুও গত কয়েক সপ্তাহে কাঠমান্ডু ও দেশের অন্যান্য প্রান্তে যা ঘটেছে, তার ব্যাপ্তি ও চরিত্র দুটোই ভিন্ন। যেন আরেক দফা ক্ষমতার রাজনীতি নয়, বরং এক প্রজন্মের সঙ্গে চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ। একদল ক্ষুব্ধ তরুণ নাগরিক হঠাৎ যেন বজ্রকন্ঠে জানিয়ে দিলো — দেশের রাজনৈতিক শ্রেণি আস্থা, সময় ও সম্ভাবনা অপচয়ের সীমা ছাড়িয়েছে।
এই বিক্ষোভের সূত্রপাত, মূলত, সরকারের প্রায় এক হাস্যকর স্বল্পদৃষ্টির সিদ্ধান্ত থেকে: ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ও এক্সসহ বিশটিরও বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিষিদ্ধ করা। সরকার যুক্তি দিয়েছিল, এসব প্ল্যাটফর্ম সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত হয়নি। কিন্তু, বাস্তবে এর ফল হয়েছিল ভয়াবহ — লক্ষ লক্ষ মানুষের ডিজিটাল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অথচ তরুণ প্রজন্ম ব্যবসা, শিক্ষা, মত প্রকাশ — সব ক্ষেত্রেই এই প্ল্যাটফর্মের উপর নির্ভরশীল। তাই এই সিদ্ধান্ত ভুলের মতো নয়, বরং যেন ইচ্ছাকৃত সেন্সরশিপ।
সরকার এই নিষেধাজ্ঞার প্রতীকী ও বাস্তব দুই দিকই ভয়ানকভাবে অবমূল্যায়ন করেছিল। কয়েক দিনের মধ্যে হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নেমে ক্ষোভকে রূপ দিলেন ক্রোধে। তারা শুধু সংযোগ হারানোর প্রতিবাদ করেননি — অভিযুক্ত করেছেন গোটা ব্যবস্থাকে: দুর্নীতির সংস্কৃতি, স্বজনপ্রীতি ও অভিজাতদের দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি, যা তাদের ভবিষ্যৎকে মূল্যহীন করে তুলেছিল।
গত ৯ই সেপ্টেম্বর, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি যিনি অতীতে বহু রাজনৈতিক সংকট পার করেছেন, তাকে পদত্যাগ করতে হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একই পথ অনুসরণ করেন। কারফিউ জারি হয়; পুলিশ টিয়ার গ্যাস, জলকামান, রাবার বুলেট এবং শেষ পর্যন্ত সরাসরি গুলি চালায়। উনিশ জন নিহত হয়। সংসদ ও দলীয় কার্যালয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সরকারি আবাসও রেহাই পায়নি। এটি নেপালের কোন চিরাচরিত রাজনীতির অংশ ছিল না। বরং এটি ছিল এক সামাজিক ভূমিকম্প।
প্রত্যেক প্রজন্ম এক সময়ে এসে বুঝতে পারে, তাদের পূর্বসূরিদের রাজনৈতিক সমঝোতা ছিল গভীরভাবে অন্যায্য। নেপালে সেই সন্দেহ এক নিশ্চিত রূপ নিয়েছে। জেনারেশন জেড (আনুমানিক ১৩ থেকে ২৮ বছর বয়সীরা) গণতন্ত্র পেয়েছে নিশ্চিতভাবে, কিন্তু সমৃদ্ধি পেয়েছে মরীচিকার মতো। যুব বেকারত্ব প্রায় ২০ শতাংশে ঘোরাফেরা করছে। প্রতিদিন হাজার হাজার তরুণ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। রেমিট্যান্স জিডিপির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ; দেশীয় উৎপাদনের চেয়ে প্রবাসীদের ঘামে অর্থনীতি বেঁচে আছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো, প্রতিদিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো দুর্নীতি। বহুল সমালোচিত “নেপো কিডস” যেখানে, রাজনীতিবিদদের সন্তানরা বিদেশি গাড়ি ও ব্যয় বহুল ডিজাইনের পোশাক পরে সেই সব সামাজিক মাধ্যমেই ছবি দিচ্ছিল, যেগুলো সরকার নিষিদ্ধ করেছিলো। এই বৈপরীত্য কাঠমান্ডুর ক্ষমতার করিডোরে পচনের ডিজিটাল প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা সরকারি পদকে পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে দেখেন, তখন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা তৈরি করা অসম্ভব।
এই প্রেক্ষাপটে সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধকরণ ছিল স্রেফ স্ফুলিঙ্গ নয়, বরং এক বিস্ফোরক। এটি বহু বছরের হতাশাকে কয়েক দিনের তাণ্ডবে পরিণত করেছে। আর রাজনীতিবিদদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে সেই পুরনো সত্য: রাজনীতিতে আস্থা একবার হারালে, ফরমান দিয়ে তা ফেরানো যায় না।
নেপালের রাজনীতি তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ভারত ও চীনের মাঝে অবস্থানরত দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দাবার বোর্ডের ন্যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিং কাঠমান্ডুতে আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যেমন অবকাঠামো বিনিয়োগ, দলীয় দ্বন্দ্ব মীমাংসা, বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়া, ইত্যাদি। ওলি নিজেও এই চীনা সক্রিয়তার সুফল ভোগ করেছেন।
কিন্তু বর্তমান সংকট এমন নয় যা বেইজিং সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। চীন স্থিতিশীলতা চাইতে পারে, গোপনে দলীয় ঐক্য উৎসাহিত করতে পারে, কিন্তু এই বিক্ষোভ কোনো পররাষ্ট্র নীতির ফল নয়। এটা সীমান্ত, বাণিজ্য বা মহাশক্তির সমীকরণ নয় — এটা মর্যাদা, সুযোগ আর জবাবদিহি নিয়ে। আর তা কোনো বাইরের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এটিই হয়তো সান্ত্বনা। নেপালের এই অস্থিরতা, যতই বিপজ্জনক হোক, মূলত দেশীয়; এখনো এটি কোনো প্রক্সি সংঘাতে পরিণত হয়নি।
তবু ঝুঁকি গভীর। ক্ষমতার শূন্যস্থান কখনো খালি থাকে না। ওলির পদত্যাগ বজ্রপাত সরিয়েছে, কিন্তু ঝড় নয়। বিক্ষোভ চলছেই। আরও মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সেনাবাহিনী নাকি পরিস্থিতি “স্থিতিশীল” করতে প্রস্তুত। রাজনৈতিকভাবে অস্থির ইতিহাসের দেশে এই শব্দ বিপজ্জনক ইঙ্গিত।
আগামীর সম্ভাবনা নাজুক আশার থেকেও রক্তাক্ত পরিণতি পর্যন্ত বিস্তৃত। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কারের পথে দেশকে নিয়ে যেতে পারে, দুর্নীতি কমাতে পারে, তরুণ নেতৃত্বের জন্য জায়গা খুলতে পারে। কিন্তু সমানভাবে এটি দমন-পীড়নের দিকেও চলে যেতে পারে, যদি ক্ষমতাসীনরা এই বিক্ষোভকে ক্ষণস্থায়ী ভেবে বসেন।
একটি ঝুঁকি হলো উগ্রপন্থার জন্ম। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন যদি গুলিতে দমিয়ে দেওয়া হয়, ক্ষোভ রূপ নেয় চরমপন্থায়। নেপালের ইতিহাসে দশকের পর দশকব্যাপী মাওবাদী সংঘাত দেখিয়ে দিয়েছে — রাজনৈতিক সহিংসতার প্রজন্মগত মূল্য দিতে হয়। একই সঙ্গে আছে ভূ-রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী সম্ভাবনা। ভারত ও চীন উভয়েই তাদের সীমান্তে স্থিতিশীলতা চায়। নেপাল অস্থিতিশীল থাকলে তারা নিজেদের স্বার্থে হয়তো কোনো পক্ষকে সমর্থন দিতে প্রলুব্ধ হতে পারে।
নেপালের যুব আন্দোলন এখন এক বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ। হংকং, ইরান, চিলি, শ্রীলঙ্কা, এমনকি সাম্প্রতিক বাংলাদেশেও তরুণেরা ইন্টারনেটের সংযোগে একত্রিত হয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক মাধ্যম এখানে সংগঠনের হাতিয়ারও আবার প্রতীকী যুদ্ধক্ষেত্রও। এটিকে নিষিদ্ধ করে নেপাল ঠিক এই কাজটাই করলো যেমন ঝড় থামাতে ছাতাগুলো বাজেয়াপ্ত করা।
সমানভাবে শিক্ষণীয় হলো এরপর কী ঘটে। কিছু দেশে, বিক্ষোভ আনে তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কার — উদাহরণস্বরূপ, চিলে তার সংবিধান নতুন করে লিখেছিল। অন্য কোথাও এগুলো ডেকে আনে দমন-পীড়ন বা রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতা — যেমন মিয়ানমার বা মিশরে দেখা গেছে। নির্ধারক উপাদান সচরাচর বিক্ষোভের আকার নয়। আসল প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক অভিজাতরা কি সেই ক্ষোভকে ব্যক্তিগত বেঁচে থাকার তাগিদে নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের পথে প্রবাহিত করতে পারে; আর বিরোধী আন্দোলনগুলো কি রাগকে সুসংহত শাসনদৃষ্টিভঙ্গিতে রূপ দিতে পারে। নেপাল এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক সেই দুইমুখী মোড়ে।
প্রায় তিন কোটি মানুষের এই দেশ, ইতিহাসের ভারে ন্যুব্জ, দুই পরাশক্তির মাঝে আটকে থাকায় একমাত্র প্রলোভনই হতে পারে সংকটকে অস্তিত্বগত হুমকি ভাবার। কিন্তু তা নয়। এটি এক সতর্কবার্তা — এবং হয়তো এক আমন্ত্রণ। গণতন্ত্র প্রায়শই ধীরে নয়, বরং হঠাৎ, অস্বস্তিকর হিসাব-নিকাশের মধ্য দিয়ে নিজেদের পুনর্গঠিত করে। গত কয়েক সপ্তাহের রক্তপাত এক ট্র্যাজেডি, কিন্তু হয়তো এটি বহুদিনের অবহেলিত জবাবদিহির মূল্য।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পুনর্গঠন — আস্থা, প্রতিষ্ঠান, নেতৃত্ব ও জনগণের সম্পর্ক নতুন করে গড়ে তোলা। এর জন্য দরকার রাজনীতিবিদদের অটল সাহস, নিরাপত্তা বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও বিক্ষোভকারীদের ধৈর্য। আন্তর্জাতিক মহলকেও উচিত নেপালের ভঙ্গুর পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে সাহায্য করা। শেষ পর্যন্ত একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক নেপালই সবার জন্য মঙ্গলজনক।
এখন মূল্যবান যে প্রশ্নটি হলো, নেপালের নেতৃত্ব কি এই সুযোগটি গ্রহণ করতে পারবে? যদি না পারে, তবে রাস্তাই সিদ্ধান্ত নেবে। আর ইতিহাস তাদের খুব কমই মনে রাখবে, যারা এক প্রজন্মের মর্যাদার দাবিকে সাময়িক ঝামেলা ভেবেছিল।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :
১. সময়ের আলো, ঢাকা : ১১ সেপ্টেম্বর, ২৫
২. সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক : ১১ সেপ্টেম্বর, ২৫
No comments:
Post a Comment