এম এ হোসাইন,
মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত বেসামরিক নেত্রী অং সাং সু চি কে এক বছর নির্জন কারাবাসের পর সম্প্রতি তাকে গৃহবন্দী হিসেবে রাজধানী নেইপিডোতে স্থানান্তর করা হয়েছে। সামরিক জান্তা কর্তৃক এই ধরনের পদক্ষেপ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের বিস্মিত করেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক বাহিনী এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এবং ক্ষমতারচ্যুত সু চিকে বিভিন্ন অভিযোগে ৩৩ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। মিয়ানমারের জরুরী অবস্থা জারি করে জান্তা সরকার বিভিন্ন সময় তাদের মেয়াদকাল বর্ধিত করেছে। মিসেস সু চির প্রতি এই নমনীয়তা এমন সময় প্রদর্শন করা হলো যখন জরুরি অবস্থার মেয়াদ চতুর্থবারের মতো বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং এই স্থানান্তরটিকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বন্দীদের প্রতি করুণার একটি কাজ দেখানো হয়েছে। তাছাড়া ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এন এল ডি) মুখপাত্রের সূত্র মতে, মিসেস সু চির পাঁচটি ফৌজদারি মামলা থেকে তাকে সরকার কর্তৃক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে এতে কোনভাবেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না যে, অং সাং সুচি শীঘ্রই মুক্ত হতে চলেছেন বরং এটি জান্তা সরকারের একটি কৌশল গত পদক্ষেপ হতে পারে যা ক্ষমতার উপর তাদের দখল বজায় রেখে দেশীয় প্রতিরোধ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সন্তুষ্ট করা।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই ব্যাপক নাগরিক বিক্ষোভ এর পাশাপাশি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধের সূত্রপাত ঘটে। জান্তা সরকারের নৃশংস প্রতিক্রিয়ার ফলে ২৬০০ জনেরও বেশি নিহত এবং ১৬,৬০০ জনের মতো রাজনৈতিক বন্দী হয়েছে। এই সশস্ত্র সংঘাতের ফলে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, বাস্তুচ্যুতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে। দেশটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে। ফলে বিদেশী বিনিয়োগ ও বাণিজ্য কমে যাওয়ায় অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে। এছাড়া জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলো সু চির গ্রেপ্তার, বিচার এবং দন্ড প্রদানকে একটি প্রহসন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত বলে আখ্যা দিয়েছে। সু চি এখনো মিয়ানমারের গণতন্ত্রের মানস কন্যা এবং সামরিক জান্তার কাছে একটি দুঃস্বপ্নের প্রতীক।
অং সাং সু চিকে সীমিত সুবিধা সংবলিত গৃহবন্দীর সিদ্ধান্ত যে জান্তা সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ নয় তা সহজেই অনুমেয়। কেননা বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন সু চির দলকে 'সন্ত্রাসী' দল হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং অপ্রয়োজনীয় মাত্রারিক্ত বল প্রয়োগ করে দমন পীড়ন চালাচ্ছে। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের সহিংসতা বন্ধ এবং সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব জারি করেছে। চীন এবং রাশিয়া ভোট থেকে বিরত ছিল কিন্তু তাদের ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করেনি। এতে প্রধান শক্তি গুলোর মধ্যে কিছুটা ঐক্য মতের ইঙ্গিত দেয়। গত জুলাই মাসে প্রথমবারের মতো একজন বিদেশী রাজনিতীবিদ, থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডন প্রমোদউইনাই সু চির সাথে দেখা করার সুযোগ পান। সু চি তাকে দেশের মধ্যে সংঘাত নিরসনে ভূমিকা রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। রেডিও ফ্রী এশিয়ার সূত্র অনুসারে, বিগত ২৭শে মে এবং ০৪ জুন এ সু চি এবং উচ্চ পর্যায়ের সামরিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে দেশের সশস্ত্র সংঘাত, জনসাধারণের নিরাপত্তা ও সর্বোপরি শান্তি স্হাপনের জন্য ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে। এছাড়াও পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার খোন মিয়াট এবং চীনের এশিয়া অঞ্চল বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ডেং শিজুন এর সাক্ষাৎ এই সংকট নিরসনে সু চির প্রভাবকে আরো গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ করে তুলেছে। বর্তমান জান্তা সরকার সু চির এই প্রভাব কে কাজে লাগিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামকে নিরসন করতে চায়।
মিসেস সু চি কে গৃহবন্দী করার কিছু সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। প্রথমত, একটি সম্ভাব্য কারণ হলো, এটি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি ইতিবাচক লক্ষণ হতে পারে। বর্তমান এই তথাকথিত সরকার যারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন থেকে দেশটির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাকে মুক্তি দেয়ার জন্য প্রচন্ড চাপের সম্মুখীন হয়েছে।এই পদক্ষেপকে সদিচ্ছার ইঙ্গিত বা উত্তেজনা কমাতে এবং সংলাপ ও আলোচনার পথ প্রশস্ত করার জন্য সহায়ক হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে এই সম্ভাব্য কারণ বেশ সন্দেহজনক। দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ হিসেবে আমরা এই পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সন্তুষ্ট করার একটি উপায় হিসেবে দেখতে পারি।বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো যারা সামরিক বাহিনী এবং তার নেতাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কাজেই এই নমনীয়তা ঐ সকল দেশগুলোকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে কিছুটা দ্বিধায় ফেলবে। তবে এই ব্যাখ্যাও আমার মতে বেশ সন্দেহজনক কেননা মিয়ানমার সেনাবাহিনী পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কোন তোয়াক্কা না করে তারা নিজেদের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করে চলেছে।
তৃতীয় সম্ভাব্য যে কারণটি হতে পারে তা হল মিসেস সু চিকে তার সমর্থক ও জনসাধারণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার এবং বহি-বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করা থেকে বিরত রাখার একটি কৌশল। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হতে পারে মিয়ানমারের লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে প্রতিরোধ এবং আশার প্রতীক হিসেবে অং সাং সুচি'র জনপ্রিয়তাকে দুর্বল করা। রাজধানী শহর নেপিডোতে গৃহবন্দী অবস্থায় কঠোর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজতর। এভাবে তাকে মানসিক চাপে রেখে নমনীয় করার কৌশল বা উপায় হতে পারে। চতুর্থ যে সম্ভাব্য কারণ হতে পারে তা হল তার বয়স এবং স্বাস্থ্যগত কারণ। মিসেস সু চি কারাগারে থাকাকালীন অসুস্থ ছিলেন বলে গুজব ছিল। এই পদক্ষেপের ফলে তার আরো উন্নত চিকিৎসা প্রাপ্তি এবং যেকোন স্বাস্থ্যগত জটিলতা এড়াতে সহজ হবে। তবে এই ব্যাখ্যাটিও অনিশ্চিত কেননা সামরিক বাহিনী তার স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করে না।
সেনা অভ্যুত্থানের পর সু চি এবং এনএলডি'র জৈষ্ঠ নেতাদের গ্রেফতারের পরপরই মিয়ানমারে গণতন্ত্রকামী এবং জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী দ্বারা সশস্ত্র প্রতিরোধ দিন দিন জোরদার হচ্ছে। বিশেষ করে যারা জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) অংশ, যা পরবর্তীতে ক্ষমতাচ্যুত আইন প্রণেতা ও কর্মীদের দ্বারা সংগটিত হয়েছিল। এই এনইউজি মায়ানমারের বৈধ সরকার বলে দাবি করে এবং জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এই জাতীয় সরকার কিছু জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথে মিলে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি ফেডারেল সেনাবাহিনী গঠন করেছে। এমত পরিস্থিতিতে, সামরিক জান্তার এ ধরনের নমনীয় পদক্ষেপ সরকারের উপর কিছুটা চাপ প্রশমনে সহায়ক হবে এবং সু চির সাথে আলোচনার পথ প্রশস্ত করবে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিদেশি কূটনীতিক বা সামরিক ব্যক্তিদের বিভিন্ন ইস্যুতে দরকষাকষি করতে বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবহার করতে আরো সহজতর হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মিসেস সু চির কারাগার থেকে গৃহবন্দিতে স্থানান্তর সামরিক বাহিনীর একটি কৌশলগত পদক্ষেপ মাত্র।
যাই হোক, মিসেস সু চির শাসনামলে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় ব্যর্থতা এবং রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র বাহিনীর জাতিগত নির্মূল অভিযানের জন্য দেশে এবং বিদেশে উভয় স্থানেই তিনি বিতর্কিত এবং সমালোচিত হয়েছেন। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠীর উপর দমন পীড়নের ফলে প্রায় ১১লক্ষ রোহিঙ্গা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে সামরিক বাহিনীর উপর জাতিগত নিধন ও গণহত্যার অভিযোগে বিচার চলমান এবং সু চি ক্ষমতায় থাকাকালী তিনি সামরিক বাহিনীকে রক্ষার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তার এই পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক সুশীলগোষ্ঠী এবং রাষ্ট্র নেতারা তার সমালোচনা করেন। তবে সকলেই গণতান্ত্রিক মিয়ানমার প্রতিষ্ঠায় ঐক্যমত পোষণ করেন।
তবে যাই হোক, এই পদক্ষেপটি এই সত্যকে পরিবর্তন করে না যে, সুচি এখনো বন্দী এবং গুরুতর অভিযোগের সম্মুখীন যা তার রাজনীতি ক্যারিয়ার ও জীবন শেষ করতে পারে। এই পদক্ষেপটি সেই সত্যকেও পরিবর্তন করে না যে, মিয়ানমার এখনো সামরিক শাসনের অধীনে এবং একটি গুরুতর রাজনৈতিক ও মানবিক সংকটের মুখোমুখি। তাই এই পদক্ষেপ মিয়ানমার ও তার জনগণের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী না হয়ে বরং অনিশ্চিত করে।
এম এ হোসাইন, একজন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
ইমেইল :writetomahossain@gmail.com
এই আর্টিকেল টি প্রকাশিত হয়েছে :
১. দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ :১৩ আগষ্ট ২৩
No comments:
Post a Comment