এম এ হোসাইন,
বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলো আবারও উপলব্ধি করছে—ক্ষমতার কেন্দ্রে না থাকলে তাদের কী পরিণতি হয়। ২১ শতকের পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার সর্বশেষ অধ্যায়ে, ওয়াশিংটন ও বেইজিং এক অর্থনৈতিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, যার সূচনা হয়েছিল শুল্ক আরোপের মাধ্যমে, কিন্তু এখন তা পরিণত হয়েছে একটি বিস্তৃত ভূরাজনৈতিক সংঘাতে যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বে। এই সংঘাত ন্যায়বিচার, মেধাস্বত্ব, ও জাতীয় মর্যাদার নামে শুরু হলেও—বাস্তবতা হলো, এই অর্থনৈতিক কুয়াশার মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলো যারা নীরবে, যন্ত্রণায়, এবং কোনো মুক্তির পথ না পেয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের হাত ধরে এই বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছিল মূলত যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার লক্ষ্য নিয়ে। কিছু যৌক্তিকতা অবশ্যই ছিল: চীনের বাণিজ্যচর্চা—যেমন প্রযুক্তি হস্তান্তরের চাপ সৃষ্টি কিংবা মেধাস্বত্ব চুরি—এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রয়োজন ছিল। শুল্ককে বেছে নেওয়া হয়েছিল সহজতম প্রতিরোধমূলক হাতিয়ার হিসেবে। তবে এই যুদ্ধ এখন কেবল সয়াবিন বা সৌর প্যানেলের বিষয় নয়—এটা এখন একটি কৌশলগত যুদ্ধ, যেখানে পাল্টা শুল্ক, প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা, এবং অর্থনৈতিক নীতিকে জাতীয় নিরাপত্তার অস্ত্র বানানো হয়েছে।
২০২৫ সালের মধ্যে, চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ১৪৫% পর্যন্ত পৌঁছেছে, আর আমেরিকান পণ্যের ওপর চীনের শুল্ক ৮৪% পর্যন্ত। দুই দেশই দাবি করছে, তারা তাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করছে। কিন্তু বাস্তবে, তারা বৈশ্বিক বাণিজ্যের কাঠামো এমনভাবে পাল্টে দিচ্ছে। এরফলে সবচেয়ে দুর্বল অর্থনীতিগুলো ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
বিশ্ব অর্থনীতি কোনো দাবার ছক নয় যেখানে চালগুলো স্পষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত। বরং এটা একটি জীবন্ত বাস্তুতন্ত্রের মতো যা পরস্পর সংযুক্ত এবং সূক্ষ্ম ভারসাম্যে স্থিত। এক জায়গায় নড়চড় হলেই অন্যখানে কম্পন লাগে। মার্কিন-চীন শুল্ক যুদ্ধ এমন এক ঝাঁকুনি দিয়েছে যা বিশ্বজুড়ে সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে, পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়িয়েছে, এবং এক অনিশ্চয়তার তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে। যার বড় ধাক্কা এসে পড়েছে সেইসব দেশে যেগুলো এরকম আঘাত সামাল দিতে অক্ষম।
স্বল্পোন্নত দেশগুলো সাধারণত কাঁচামাল, কৃষিপণ্য, কিংবা শ্রমনির্ভর তৈরি পোশাকের মতো পণ্যের রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। তাদের অর্থনীতি এক বা দুইটি খাতের ওপর নির্ভরশীল, অবকাঠামো দুর্বল, এবং শ্রমবাজার অপ্রাতিষ্ঠানিক। যখন বৈশ্বিক বাণিজ্যে স্থবিরতা নামে যেমনটি ঘটেছে এই শুল্ক যুদ্ধ ও কভিড-১৯ মহামারির পরবর্তী ধাক্কায়—তখন এসব দেশ বৈদেশিক মুদ্রা ও কর্মসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হারায়। রপ্তানি আয় কমে, বাজেট সংকুচিত হয়, এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অর্জিত অগ্রগতি ধ্বংসের মুখে পড়ে।
এই ক্ষতির পেছনে চীনের কৌশলগত অভিযোজনও ভূমিকা রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার হারিয়ে, বেইজিং এখন ঝুঁকছে উন্নয়নশীল বাজারের দিকে। চীনের প্রণোদনাপ্রাপ্ত ও রাষ্ট্রীয় সমর্থনপুষ্ট পণ্য এখন সয়লাব করে দিচ্ছে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজার। এইসব অঞ্চলের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছেন, এখন চীনা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করাও অসম্ভব হয়ে উঠছে।
উদাহরণস্বরূপ, ইথিওপিয়ার তৈরি পোশাক শিল্প একসময় চীনের নিম্নব্যয় শিল্পকে গ্রহণ করে শিল্পায়নের মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু এখন চীনা টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠানগুলো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে রপ্তানি করে বা দামের দিক থেকে ইথিওপিয়ান পণ্যকে বাজার থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। একই ঘটনা ঘটছে কেনিয়ার কৃষি, বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক অ্যাসেম্বলি, এবং গুয়েতেমালার কফি রপ্তানিতে।
এদিকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ —যেটি বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ হিসেবে পরিচিত তা এখন অনেক স্বল্পোন্নত দেশের ওপর চীনের প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এসব প্রকল্পের ঋণ শর্ত অস্পষ্ট, কাজগুলো অনেক সময় প্রলম্বিত, আর ঋণের বোঝা দুঃসহ। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের দীর্ঘ মেয়াদি লিজের ঘটনাটি এখনও সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচিত। জাম্বিয়া ও লাওসের মতো দেশগুলোও বাড়তে থাকা ঋণের বোঝায় পর্যুদস্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ওয়াশিংটনের নীতি কখনো রক্ষণশীল পন্থায় ফিরে যায়, আবার কখনো "মিত্রদের দিয়ে সরবরাহ ব্যবস্থা গড়া"র মতো স্লোগানে আটকে থাকে। আফ্রিকান গ্রোথ অ্যান্ড অপরচুনিটি অ্যাক্ট (AGOA) কিংবা উন্নয়নের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগের আরও ভালো ব্যবহার অ্যাক্টের (BUILD) মতো প্রকল্পগুলোর তহবিল সীমিত ও অনুচ্চারিত। বাইডেন প্রশাসনের তথাকথিত “শ্রমিক-কেন্দ্রিক” বাণিজ্যনীতি ছিলো মূলত ঘরোয়া শ্রম ইউনিয়নকে তুষ্ট করার একটি প্রচেষ্টা মাত্র।
অন্যদিকে, ইউরোপ অনেক বড় বড় কথা বললেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের গ্লোবাল গেটওয়ে প্রকল্প কিছু শক্তিশালী অবকাঠামো উদ্যোগ নিলেও এর ব্যাপ্তি এখনও সীমিত। ফলে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি সমন্বিত, মূল্যভিত্তিক অর্থনৈতিক কৌশলের জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে।
কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বিচ্ছিন্নতাকে সুযোগ হিসেবে দেখেন। ভাবনাটা এমন, চীন নির্ভরতা কমাতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো "চায়না-প্লাস-ওয়ান" কৌশলে যেমন ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারতকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তাতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো লাভবান হবে। কিছুটা হয়েছে বটে যেমন ভিয়েতনাম ইলেকট্রনিক বিনিয়োগ পেয়েছে, বাংলাদেশ পোশাক শিল্প শক্তিশালী করেছে, মেক্সিকো পেয়েছে উৎপাদন কেন্দ্র।
কিন্তু এগুলো ব্যতিক্রম, সাধারণ নিয়ম নয়। অধিকাংশ স্বল্পোন্নত দেশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, নীতিগত সামঞ্জস্যতা বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব রয়েছে, যা তাদেরকে বাস্তবসম্মত বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠতে বাধা দিচ্ছে। আর যেসব শিল্প খাত স্থানান্তরিত হচ্ছে, সেগুলো মূলত কম লাভজনক এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ—অর্থাৎ এমন ধরনের কাজ যা অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গতিবৃদ্ধির সঙ্গে সবার আগে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাস্তবে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বৈশ্বিক বাণিজ্যের অংশীদার হিসেবে নয়, বরং একটি আরও বিভাজিত ও আঞ্চলিকীকৃত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভোগ্য উপাদান হিসেবে পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে।
তাহলে করণীয় কী? প্রথমত, অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ এখন আর বিলাসিতা নয়। এটা টিকে থাকার পূর্বশর্ত। রুয়ান্ডা যেমন ধীরে ধীরে ডিজিটাল সেবা খাত গড়ে তুলছে, বা ঘানা কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ করছে—এগুলো পথ দেখাচ্ছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন শুধু অবকাঠামো নয়—মানসম্পন্ন শিক্ষা, সুশাসন এবং কার্যকর বিধিব্যবস্থা।
দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক সংহতি শুধু মুখের বুলি নয়, বাস্তবে রূপ দিতে হবে। আফ্রিকান কন্টিনেন্টাল ফ্রি ট্রেড এরিয়া (AfCFTA) ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০% পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বাড়াতে পারে। কিন্তু এর পথে বাধা প্রচুর—নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতা, অবকাঠামোর দুর্বলতা, রাজনৈতিক অনিচ্ছা।
তৃতীয়ত, আর্থিক দায়িত্ববোধ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। যেমন সহজ শর্তে ঋণ গ্রহণ করে অপচয়মূলক প্রকল্প ব্যয় এর প্রবনতা, বিশেষ করে যখন বৈশ্বিক পুঁজি লাভের খোঁজে ছুটছে। তাছাড়া, শ্বেতহস্তী প্রকল্প, অনাবশ্যক বিমানবন্দর কিংবা জনশূন্য শহর বাস্তবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে তুলতে খুব সামান্যই সাহায্য করে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, সড়ক যোগাযোগ, ডিজিটাল প্রবেশাধিকার এবং মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো।
সবশেষে, বিশ্বের পরাশক্তিগুলোকে স্বীকার করতে হবে তাদের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের তরঙ্গ কতটা দূর পর্যন্ত পৌঁছায়। যুক্তরাষ্ট্র যদি মুক্ত বাজার অর্থনৈতিক বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে চায়, তাহলে তাকে কেবল নিজের স্বার্থ নয়—বিশ্বের স্থিতিশীলতার কথাও ভাবতে হবে। বাণিজ্য সুবিধা, সক্ষমতা গড়ে তোলা, এবং ন্যায্য বাজার প্রবেশাধিকার—এসব হতে হবে নীতির অংশ। আর যদি চীন একটি দায়িত্বশীল অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হতে চায়, তাহলে তাকে তার ঋণের সুযোগ সন্ধানী দিকগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং অংশীদারদের স্বাধীন কর্মপন্থাকে সম্মান জানাতে হবে।
ইতিহাস কখনোই ক্ষমতাধরদের ক্ষমতার বাইরে থাকা বিশ্বকে ভুলে যাওয়ার অপরাধ ক্ষমা করে না। যুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্ক যুদ্ধ হয়তো একদিন একপক্ষের বিজয়ে শেষ হবে, কিন্তু ইতিমধ্যেই হেরেছে কোটি কোটি মানুষ। এই যুদ্ধে যাদের নেই কোনো সম্মতি, নেই কোনো কণ্ঠ, আর নেই কোনো উপায় যেখানে এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারে।
যদি আমরা এমন একটি বিশ্বব্যবস্থায় বিশ্বাস করি যা উন্মুক্ত, নিয়মভিত্তিক এবং ন্যূনতম মাত্রায় ন্যায়সঙ্গত, তবে সেটি এমন হতে পারে না যেখানে দূর্বল দেশগুলোকেই সর্বদা সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়। অথচ এই মুহূর্তে আমরা ঠিক এমনই এক বিশ্বে বসবাস করছি।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :
১. দৈনিক সংবাদ, বাংলাদেশ : ১৭ এপ্রিল, ২৫
No comments:
Post a Comment