এম এ হোসাইন,
দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জলবায়ুগত ঝুঁকি মোকাবিলায় দীর্ঘদিন ধরে দৃঢ়তা প্রদর্শনকারী বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে বিশ্ব গার্মেন্টস বাজারে এক বিস্ময়কর স্থান অর্জন করেছে। তবে গত সপ্তাহে ঢাকায় যখন বৈশ্বিক সিইও, ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ও বাণিজ্যিক দূতেরা বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫-এ একত্রিত হলেন, তখন পরিবেশ ছিল কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে উচ্চাকাঙ্ক্ষার। এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তা যেন ইঙ্গিত দিচ্ছিলো—একটি দেশ তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত এই সম্মেলনটি একটি পরিপক্বতার মুহূর্ত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। বার্তাটি ছিল স্পষ্ট: বাংলাদেশ তার ‘বিশ্বের সেলাই কারখানা’ ইমেজ থেকে বেরিয়ে এসে ‘স্টার্টআপ ল্যাব’ হতে চায়। বিশ্ব বাণিজ্যের প্রান্ত থেকে বাংলাদেশকে কেন্দ্রের দিকে নিয়ে আসবে। এটি ছিল সম্ভাবনার এক মহা মঞ্চায়ন। কিন্তু প্রতিটি মঞ্চায়নের পর একটি সাধারণ প্রশ্ন থেকেই যায়: পর্দা নামার পর কী হবে?
বিডা’র চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেছেন, এই সম্মেলন কেবল চকচকে প্রতিশ্রুতি বা ছবির ফ্রেমে আটকে পড়া নয়, বরং এটি ছিল একটি নতুন পরিচয়ের ভিত্তি স্থাপন। যেখানে বাংলাদেশকে প্রযুক্তি, লজিস্টিকস এবং গ্রিন এনার্জির উচ্চ প্রবৃদ্ধিসম্পন্ন গন্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। চীনের দীর্ঘমেয়াদি অভিপ্রায় নিয়ে বৈশ্বিক সন্দেহ ও ভারতের আমলাতান্ত্রিক ক্লান্তির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের এই বার্তা কিছুটা হলেও বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য বেশ স্বস্তির ছিলো।
দৃশ্যপট ছিল খুবই আকর্ষণীয়। ইন্ডিটেক্স (জারা’র মূল প্রতিষ্ঠান), স্যামসাং সি অ্যান্ড টি, টেলিনর এশিয়া-র নির্বাহীরা যুক্তরাজ্য ও ফিনল্যান্ডের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়েছেন। প্যানেল আলোচনায় ছিলো উদ্ভাবন ও রূপান্তরের ঝলক। ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ কানেক্ট ২০২৫’ প্রোগ্রামে ইনফিউশন পার্টনার্সের মতো নতুন ফান্ডগুলো তরুণ শক্তির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। যা দেশের ডেমোগ্রাফিক সুবিধাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে ৭০% জনসংখ্যা ৩৫ বছরের নিচে। আরোও ছিলো রাজনৈতিক পরিপক্বতার এক বিরল দৃশ্য যেখানে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা সকলেই এক মঞ্চে। এটা যদি ঢাকায় এক অলৌকিক ঘটনা না হয়, তাহলে আর কী?
তবু, প্রতিটি আশাবাদের গল্পে যেমন হয়, তার আসল বাস্তবতা লুকিয়ে থাকে গল্পের অভ্যন্তরেই।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর এ ধরনের সম্মেলনে একটি নির্ধারিত ছক থাকে—বড় কথা, আরও বড় প্রত্যাশা, তারপর ধীরে ধীরে হতাশা। বাংলাদেশ এমন দৃশ্য আগেও দেখেছে: দুর্দান্ত কৌশল, কিন্তু মাঝারি বাস্তবায়ন। এই সম্মেলনের আশাবাদের মাঝেও দেশের কিছু 'আকিলিস হিল' উপেক্ষা করা যায়নি।
উদাহরণ হিসেবে অবকাঠামোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।সম্মেলনে বক্তৃতাগুলো ছিল ডিজিটাল যুগের, কিন্তু বাস্তবে রাস্তা ও বন্দর দাঁড়িয়ে আছে শিল্পযুগে। রপ্তানির মূল চালিকা শক্তি চট্টগ্রাম বন্দর এখনো অপ্রতুল ও জটিলতায় ভরা। জ্বালানি ঘাটতি এখনো শিল্প অঞ্চলে উৎপাদনে বাধা—কারখানাগুলো প্রায়শই অর্ধেক সক্ষমতায় চলতে বাধ্য হয়। ২০২৬ সালের মধ্যে এলএনজি স্থিতিশীলতার আশ্বাস কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করলেও, মনে রাখা প্রয়োজন, বিনিয়োগকারীরা বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে কাজ করেন।
এরপর আসে আমলাতন্ত্র। সম্মেলনে আমলাগন ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল, কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনের সময় থাকেন মুখ গম্ভীর করে। বাংলাদেশ ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করেছে ঠিকই, কিন্তু ঢাকায় কারখানা খুলতে চাওয়া যেকোনো উদ্যোক্তার অভিজ্ঞতা বলে—সেবাটি এক স্টপেই শেষ হয় না। অনিশ্চিত নিয়ন্ত্রণ কাঠামো কেবল একটি পাদটীকা নয়—এটাই মূল গল্প।
সম্মেলনের আয়োজনে উল্লেখযোগ্যভাবে তুলে ধরা স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমটি একযোগে সম্ভাবনা ও বিরোধাভাসের প্রতিফলন। বিকাশ ও 10 মিনিট স্কুলের মতো কোম্পানিগুলো দেখায় যে, উদ্ভাবন এখানে বিকশিত হতে পারে। কিন্তু এরা এখনো ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়। যথার্থভাবেই অ্যাংকারলেস বাংলাদেশের রাহাত আহমেদ উল্লেখ করেছেন, অধিকাংশ স্থানীয় স্টার্টআপ এখনো টিকে আছে অনুদানের ওপর, টেকসই ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ওপর নয়। অর্থাৎ, এখানকার স্টার্টআপ জগৎ এখনো ‘এক্সিট’ বা আইপিও সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে—যা একে পরিণত বাজার নয়, বরং এক প্রকার জুয়ার মঞ্চে পরিণত করেছে।
সবকিছুর ওপর ছায়ার মতো রয়েছে রাজনীতি। বিনিয়োগকারীরা শুধু অর্থনীতিতে নয়, একটি সিস্টেমে বিনিয়োগ করে। নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস “সমতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা”-র প্রতিশ্রুতি দিলেও, একটি সম্মেলন বহু বছরের অস্থিরতা ভুলিয়ে দিতে পারে না। ২০২৪ সালের অশান্তি, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট অনিশ্চয়তা ও হঠাৎ নীতিগত পরিবর্তনের স্মৃতি এখনো ঢাকার আকাশে ধোঁয়ার মতো রয়ে গেছে।
তবে পুরো উদ্যোগটিকে শুধুমাত্র প্রদর্শনী ভেবে উড়িয়ে দেওয়া ভুল হবে। বাহ্যিক চাকচিক্যের নিচে ছিল একটি প্রকৃত তাড়না—এক ধরনের উপলব্ধি যে, বাংলাদেশের সময় ফুরিয়ে আসছে। বৈশ্বিক বিনিয়োগ সম্প্রদায় চঞ্চলপ্রকৃতি; সুযোগেরও একটি আয়ুষ্কাল থাকে।
তবুও কিছু আশাজাগানিয়া দিক রয়েছে, যেগুলো বিবেচনা করার মতো। ভারতের ও চীনের মাঝখানে অবস্থিত বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে আসিয়ান+ অর্থনীতির সঙ্গে কৌশলগতভাবে সংযুক্ত করেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এখন আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের চেয়েও বেশি প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা দিতে শুরু করেছে। ট্যাক্স ছুটি, মুনাফা পুনঃপ্রেরণ, এবং দীর্ঘমেয়াদি জমি ইজারা এখন আর শুধু নীতির বিষয় নয়—সক্ষম সরকারের হাতে এগুলো পরিণত হয়েছে বিনিয়োগ টানার চুম্বকে।
সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো—বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের দিকটিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ড ইউনূসের “উদ্দেশ্যযুক্ত ব্যবসা” কথাটি পশ্চিমাদের কানে অতিরঞ্জিত লাগতে পারে, কিন্তু জলবায়ু সংকট যেখানে বাস্তব, সেখানে এটি প্রাসঙ্গিক ও জরুরি। সবুজ জ্বালানি ও সামাজিক প্রভাবভিত্তিক বিনিয়োগ কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়—এগুলো এখন টিকে থাকার উপায়। এক্সিলারেট এনার্জি ও মারুবেনির মতো সংস্থাগুলোও এর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে।
চীন, চিরকালই সুযোগ সন্ধানী তাই এই ইঙ্গিত তারা ঠিকই লুফে নিয়েছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনায় আগ্রহী ৬০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছে। বেইজিং বাংলাদেশকে একটি লজিস্টিক হাব এবং ফিনটেক পরীক্ষাগার হিসেবে দেখছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—ঢাকা কি চীনা আগ্রহকে কাজে লাগাতে পারবে, না কি চীনের শর্তে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে?
তাহলে সামনে কী?
বাংলাদেশের বিনিয়োগ গল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ৭-১০ এপ্রিলের মাঝের ঘটনাগুলোর ওপর নয়, বরং ২০২৬ সালের আগ পর্যন্ত কী হয় তার ওপর। বিডা’র রিয়েল-টাইম ইনভেস্টমেন্ট ট্র্যাকিং ব্যবস্থা কি সত্যিই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারবে? চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন, কাস্টমস পদ্ধতির সরলীকরণ এবং আড়াইহাজারে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অগ্রগতি কি পাওয়ারপয়েন্ট থেকে বাস্তবে নামবে? অন্তর্বর্তী সরকার কি আবার দলীয় সংকীর্ণতায় ফিরে যাবে, নাকি সামষ্টিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে?
যদি এসব প্রশ্নের উত্তর হয় ‘হ্যাঁ’, তাহলে বাংলাদেশ সত্যিই ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানগুলোর গর্বের গল্পে পরিণত হতে পারে—যেখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবায়ন মিলেছে।
কিন্তু ইতিহাস যদি পথপ্রদর্শক হয়, তাহলে এই সম্মেলনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে—যেমনটা অনেক উদীয়মান অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেখা গেছে: আলোঝলমলে মঞ্চ, আকর্ষণীয় বক্তব্য, কিন্তু কোনো পরবর্তী অধ্যায় নেই। বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরেই অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। হয়তো এই সম্মেলনের মাধ্যমে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছে। কিন্তু ভালো শুরু হলেও তার জন্য প্রয়োজন আরও ভালো সমাপ্তি। বিশ্ব এখন বার্তাটি শুনেছে। এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তব রূপ দেওয়া।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :
১. দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ : ১২ এপ্রিল, ২৫
No comments:
Post a Comment