এম এ হোসাইন,
প্রায় তিন বছর ধরে ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বশক্তিগুলোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি গ্রাস করে আসছে। যুদ্ধক্ষেত্র পরিণত হয়েছে স্থবিরতায়, কূটনীতি খুব কম ফল দিয়েছে, আর পশ্চিমা কৌশলগুলো ক্রমেই অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি বলে মনে হচ্ছে। ভূ-রাজনীতির অন্তরালে কিন্তু আরও গভীর এক বাস্তবতা গড়ে উঠছে—রাশিয়া ও পশ্চিম এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক শিক্ষার পথে হাঁটছে। অপমান ও বিশ্বাসঘাতকতার কঠিন পরীক্ষায় গড়া রাশিয়া শিক্ষা নিয়ে নিজের কৌশল বদলেছে। আর পশ্চিম আটকে আছে আত্মপ্রবঞ্চনার এক বৃত্তে, যেখানে পুরোনো ভুলগুলো নতুন সাজে বারবার ফিরে আসছে। এই ব্যবধানই বোঝায় কেন মস্কো প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও টিকে আছে, আর পশ্চিমা বিশ্ব অসীম সম্পদ থাকা সত্ত্বেও অচলাবস্থায় ভাসছে।
রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই ইতিহাসের কঠিন বিদ্যালয়ের ছাত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, নব্বইয়ের দশকের বিশৃঙ্খলা, এবং ন্যাটো সম্প্রসারণ না করার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ—এসব ক্ষত রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রতিটি অভিজ্ঞতাই মস্কোকে এক শিক্ষা দিয়েছে: পশ্চিমা আশ্বাস ক্ষণস্থায়ী, প্রায়ই মূল্যহীন। এখান থেকে রাশিয়া তিনটি শিক্ষা নেয়। প্রথমত, রাষ্ট্রকেই সার্বভৌমত্বের সর্বশেষ রক্ষক হতে হবে। পুতিন তাঁর শুরুর বছরগুলো ব্যয় করেছেন দুর্বৃত্ত অলিগার্কদের বশ মানাতে, আর্থিক অভিজাতদের জাতীয় অগ্রাধিকারের অধীনে আনতে। পশ্চিম যাকে কর্তৃত্ববাদ বলে তিরস্কার করে, সেই ব্যবস্থা রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞার ঝড় সামলাতে সহায়তা করেছে।
দ্বিতীয়ত, মস্কো শিখেছে সংহতিই শক্তি। অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ থাকলেও যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে রাশিয়া এক কণ্ঠে কথা বলে। ক্রেমলিনে বিভেদ সীমিত, কিন্তু পশ্চিম রয়ে গেছে মিত্র ও ক্লায়েন্ট রাষ্ট্রের এক জটিল প্যাঁচ যারা কাগজে শক্তিশালী হলেও চাপের মুখে ভঙ্গুর। তৃতীয়ত, রাশিয়া বুঝেছে, চুক্তি কেবল তখনই কার্যকর যখন তা বাস্তবায়নের ইচ্ছা থাকে। মিনস্ক-টু চুক্তি যা মস্কোর চোখে ছিল কেবল ইউক্রেনকে অস্ত্রে সজ্জিত করার জন্য সময় ক্রয়ের পশ্চিমাদের এক চাল। এখন সেই শিক্ষা আরও স্পষ্ট হয়েছে। সেই ক্ষতের অভিজ্ঞতায় ক্রেমলিন এখন আলোচনায় এক কঠোর বাস্তববাদী অবস্থান নিয়েছে: কর্মে প্রতিফলিত না হলে কথার জালে আর দ্বিতীয়বার ধরা দেবে না।
ইউরোপ এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তাদের আচরণ কোনো শিক্ষণ-প্রক্রিয়া নয়, বরং এক বন্ধ বৃত্ত—সেখানে সম্মেলন, বিবৃতি আর প্রস্তাবনা ঘুরপাক খায়, কিন্তু মৌলিক অনুমান কখনোই বদলায় না। এই বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেই বিশ্বাস—যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করা হলে রাশিয়া একদিন তার লাল রেখা মেনে নিতে বাধ্য হবে। এই কল্পনাই “শান্তি কাঠামো” আর “নিরাপত্তা নিশ্চয়তা” নিয়ে অন্তহীন আলোচনাকে টিকিয়ে রেখেছে, যদিও মস্কো বহুবার স্পষ্ট জানিয়েছে: ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তি নয়, বিদেশি সেনা মোতায়েন নয়, আর রুশভাষী জনগণের নিরাপত্তার প্রকৃত নিশ্চয়তা চাই। এগুলো কোনো দর-কষাকষির বিষয় নয়—এগুলো অনড় শর্ত। তবুও পশ্চিমা নেতারা এগুলোকে যেন প্রাথমিক প্রস্তাব বলে ধরে নেন। তারা “যুদ্ধ-পরবর্তী বন্দোবস্ত” নিয়ে নকশা আঁকেন, এমনকি সেনা পাঠানোর কথাও বলেন, মস্কোর স্পষ্ট প্রত্যাখ্যানকে উপেক্ষা করে। এ যেন এমন এক কূটনীতি, যেখানে প্রতিপক্ষ নেই—পশ্চিমারা আলোচনায় বসে রাশিয়ার সাথে নয়, নিজেদের সাথেই।
এই প্রবণতাকে বলা যায় আত্ম-কূটনৈতিক ভ্রম—এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক ভ্রান্ত আত্মতুষ্টি, যেখানে পশ্চিমা নেতারা নিজেদের মধ্যে জটিল আলোচনা চালান, অথচ সেই প্রতিপক্ষকে বাদ দেন যার অবস্থান প্রকৃতপক্ষে নির্ধারক। ফলে কূটনীতির উদ্দেশ্য তখন আর দ্বন্দ্ব নিরসন নয়, বরং নিজেদের ভ্রান্ত আত্মতুষ্টির অনুভূতি টিকিয়ে রাখা। ইউরোপ, যে মহাদেশ দুই-দুটি বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা সহ্য করেছে, অথচ আজ তারা এমন আচরণ করছে যেন ইতিহাস ঐচ্ছিক কোনো বিষয়। পরাশক্তিগুলো কখনোই চাপে তাদের মৌলিক নিরাপত্তা স্বার্থ ত্যাগ করে না। এটি স্বীকার করার বদলে ইউরোপীয় নেতারা বিশ্বাস করেন যে শীর্ষ সম্মেলন আর নিষেধাজ্ঞাই ফলাফল তৈরি করতে সক্ষম। ১৯১৯ সালের ভার্সাই চুক্তিই তাদের সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল: মিত্রশক্তিরা জার্মানির উপর শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিল, অথচ সেখান থেকে যে ক্ষোভের বীজ বপন হলো, তার হিসাব রাখেনি। এক প্রজন্মের মধ্যেই তার ফল হলো হিটলার। রাশিয়ার নেতৃত্ব ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে যেন তাদের সঙ্গে ভার্সাইয়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আর ইউরোপ, অবিশ্বাস্যভাবে সেই শিক্ষা ভুলে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অনেক বেশি জটিল। একদিকে তাদের কর্মকর্তারা এখনো উত্তেজনা বাড়ানোর ভাষা ব্যবহার করছেন। ইউক্রেনকে দীর্ঘ-পাল্লার অস্ত্র দেওয়ার প্রস্তাব ছুড়ে দিচ্ছেন বা রাশিয়ার ছাড় আদায়ের জন্য ইচ্ছামতো সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছেন। অন্যদিকে এ ইঙ্গিতও আছে, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে ওয়াশিংটন হয়তো আরও বাস্তবসম্মত মূল্যায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তার ইউরোপীয় মিত্রদের পাশ কাটিয়ে সরাসরি মস্কোর সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর ইউরোপীয়দের ছেড়ে দিচ্ছে তাদের নিজস্ব ভ্রান্ত বৃত্তে। আবার এমনও হতে পারে যে আমেরিকাও ইউরোপের মতো অন্ধ, একই অলীক কল্পনার ফাঁদে আটকে আছে। তৃতীয় সম্ভাবনাও আছে—ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো ইউরোপীয় বিতর্ককেই রাশিয়ার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত দর-কষাকষির একধরনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু একমাত্র প্রথম পথই প্রকৃত শিক্ষা প্রতিফলিত করে; অন্য দুটি কেবল সেই ব্যর্থ চক্রকেই দীর্ঘায়িত করবে।
রাশিয়ার সুবিধা তার শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নয় বরং তার বাস্তববাদ। কারণ জিডিপি ও সামরিক ক্ষমতায় ন্যাটো এখনো রাশিয়া থেকে বহুগুণে বড়। মস্কো জানে নিজের সীমা, জানে ইতিহাস, আর বোঝে টিকে থাকার অর্থ হলো এককপরাশক্তি হওয়ার ভ্রান্তি এড়িয়ে চলা। পশ্চিমারা বরং সেই ভ্রান্তিতেই আঁকড়ে ধরে আছে। তারা ভেবেই নেয় সম্পদ মানেই ফলাফল, কথাবার্তাই কৌশল এবং সর্বোপরি তাদের চাওয়াই প্রতিপক্ষের জন্য শেষ উপায়। এই মানসিকতা পঙ্গুত্ব ডেকে আনে: পশ্চিমারা যুদ্ধের অবসান চায়, কিন্তু কোন শর্তে সম্ভব তা স্বীকার করতে চায় না।
যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই ইউরোপের ভ্রান্ত চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তবে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রক্ষার সুযোগ এখনও তার হাতে থাকবে। এর মানে মস্কোর কাছে আত্মসমর্পণ নয়, বরং এই স্বীকৃতি যে আলোচনা অবশ্যই বাস্তবতার ভিত্তিতে হতে হবে, পশ্চিমাদের অলীক একক পরাশক্তির কল্পনায় নয়। কিন্তু যদি ওয়াশিংটন ইউরোপের সেই চক্র আঁকড়ে ধরে থাকে, তবে তা নিজেকেই অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে। অন্যদিকে, মস্কো তার সাফল্যকে আরও মজবুত করবে এবং নিজের শর্তে ইউরোপের মানচিত্র নতুনভাবে আঁকবে। ইউরোপের জন্য সেই ফলাফল হবে আরও ভয়াবহ। যে মহাদেশ একসময় মেটার্নিখ ও বিসমার্কের মতো রাষ্ট্রনায়ক সৃষ্টি করেছিল, এখন কেবল কমিটি ও ঘোষণাপত্রই উৎপাদন করে। শিক্ষা নিতে অস্বীকার করে ইউরোপ আসলে নিজেকে সেই সংঘাতে প্রান্তিক হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলছে যা তার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নির্ধারণ করবে।
মূলত, ইউক্রেন যুদ্ধ ভূ-রাজনৈতিক শিক্ষার এক পরীক্ষা। রাশিয়া প্রমাণ করেছে তারা অতীতের সকল অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেদেরকে তৈরি করেছে। প্রতারণার ক্ষত থেকে শিক্ষা নিয়েছে, ভুল পুনরাবৃত্তি না করার দৃঢ় সংকল্প করেছে এবং অভিজ্ঞতাকে কৌশলে রূপান্তর করতে দক্ষ হয়ে উঠেছে। পশ্চিমারা, বিশেষত ইউরোপ, এখনো তার ভ্রান্ত ধারণা থেকে উত্তীর্ণ হতে পারছে না। ইতিহাস সাধারণত তাদেরই পুরস্কৃত করে যারা শিক্ষা নেয়, আর যারা শিক্ষা নেয় না তাদের শাস্তি দেয়। পশ্চিমা নেতারা যদি এই শিক্ষা না নেন, তবে তাদের ভ্রান্তির মূল্য দিতে হবে শুধু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার মাধ্যমে নয়, বরং নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা, ঐক্য, আর উদীয়মান বিশ্বব্যবস্থায় অবস্থান হারানোর মধ্য দিয়েও।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :
১. সময়ের আলো, ঢাকা : ০৬ সেপ্টেম্বর, ২৫
২. দৈনিক সংবাদ, ঢাকা : ০৮ সেপ্টেম্বর, ২৫
No comments:
Post a Comment