Saturday, 3 May 2025

'রাখাইন করিডোর' : একটি ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণ

এম এ হোসাইন, 

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে 'মানবিক করিডোর' গঠনে বাংলাদেশের নীতিগত সম্মতির ঘোষণা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে শুধু বিনীত সম্মতি নয়, বরং গভীর পর্যালোচনার আহ্বান জানানো উচিত। কারণ এমন উদ্যোগ, যতটা মানবিক উদ্দেশ্যপ্রসূতই হোক না কেন, ভৌগোলিক জটিলতা, ভূ-রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সংঘাতে অনেক সময় আশঙ্কাজনক পরিণতির জন্ম দেয়।

মিয়ানমারের সেনা দমন-পীড়ন থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার দীর্ঘদিনের অনিচ্ছুক আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ এবার আরেক মানবিক সঙ্কটের কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে এবার আর শুধু শিকার নয়, বরং এক ধরনের সক্রিয় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছে ঢাকা। এই রূপান্তর — যত মহৎই মনে হোক না কেন — বহুমাত্রিক ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে, যার প্রতিটি দিক খোলা চোখে বিশ্লেষণ করা জরুরি।

প্রথমেই বলা উচিত, এই করিডোর শুধুই ত্রাণ পরিবহনের রাস্তা নয়। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, এটি একটি কূটনৈতিক বার্তা ও কৌশলগত প্রভাবের মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে। করিডোর স্থাপনের যুক্তি আপাতদৃষ্টিতে মানবিক: রাখাইনে দুর্ভিক্ষসম অবস্থা, অর্থনীতির ধ্বংস, এবং নতুন শরণার্থী ঢলের আশঙ্কা। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এক নির্মম চিত্র এঁকেছে—যেখানে খাদ্যের অভাব, যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা ও হতাশার বিস্তার রয়েছে। এইরকম পরিস্থিতিতে মানবিক করিডোরের দাবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু ইতিহাস জানায়, এসব করিডোর খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের মূল উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

চেচনিয়ার গ্রোজনি, সিরিয়ার আলেপ্পো কিংবা ইউক্রেনের দোনবাস—এইসব স্থানে মানবিক করিডোরগুলো কখনো নিরাপদ পথ হয়ে ওঠেনি। বরং সেগুলো পরিণত হয়েছে সংঘর্ষ, অস্ত্র পাচার ও কৌশলগত ব্যবহারের মঞ্চে। বাংলাদেশ কি এর ব্যতিক্রম হতে পারবে?

করিডোরের ভৌগোলিক বাস্তবতাই ঢাকার নীতিনির্ধারকদের নির্ঘুম রাখার মতো। এটি এমন অঞ্চল দিয়ে যাবে, যেগুলো বর্তমানে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে—যারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। এদিকে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সব রকম পরিবহনপথ বন্ধ করে রেখেছে, শুধুমাত্র বাংলাদেশের দিকটিকে সম্ভাব্য প্রবেশমুখ হিসেবে রেখেছে। ফলে এই করিডোর মানবিক পথের পাশাপাশি কৌশলগত হাইওয়েতেও পরিণত হতে চলেছে।

এবং এখানেই বিপদের শুরু। কোন করিডোরই রাজনীতি বিহীন ভাবে পরিচালিত হয় না। বাংলাদেশ এখন এমন এক ত্রিমুখী জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে যেখানে রয়েছে  মিয়ানমারের জান্তা, আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীন ও ভারতের অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী স্বার্থ। ফলে এই মানবিক করিডোরটি আসলে একটি ভূ-রাজনৈতিক দাবার চাল হয়ে উঠছে।

ঘটনাটিকে আরও জটিল করে তুলেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এর পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো স্পষ্ট ঐকমত্য না থাকা। বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকদের মতে, এই প্রস্তাব সরকার বা নাগরিক সমাজে ব্যাপক আলোচনার মধ্য দিয়ে গৃহীত হয়নি। অনেক রোহিঙ্গা নীতিনির্ধারক নাকি গণমাধ্যম থেকেই এ সিদ্ধান্তের কথা প্রথম জানতে পেরেছেন। এটাই স্পষ্ট করে যে এখানে স্বচ্ছতা ত্যাগ করা হয়েছে তাড়াহুড়োর নামে।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এই করিডোর হয়তো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে। তখন প্রশ্ন উঠবে—এই সাহায্য আসলেই বেসামরিক নাগরিকদের কাছে পৌঁছাচ্ছে, নাকি যোদ্ধাদের কাছে? বাংলাদেশ কিভাবে নিশ্চিত করবে এই সরবরাহের ব্যবহার কোথায় হচ্ছে? যদি এই করিডোর অস্ত্র বা মাদক পাচারের আড়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে দায় কার?

সুতরাং, ভবিষ্যতে এধরণের প্রস্তাবিত করিডোর, এমনকি যদি জাতিসংঘ কর্তৃক অনুমোদিতও হয়, তবে তা অবশ্যই ঢাকার পূর্ণ পরিচালনাগত নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এই ধরনের তদারকি ছাড়া, অপ্রত্যাশিত এবং সম্ভাব্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই সতর্কীকরণটি বিচক্ষণ এবং সময়োপযোগী উভয়ই - তবুও, ভূ-রাজনীতিতে প্রায়শই যেমনটি ঘটে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলি শব্দের কারসাজির মধ্যে লুকিয়ে থাকে, যা উদ্বেগজনকভাবে অস্পষ্ট থাকে।

আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। চীন দীর্ঘদিন ধরে রাখাইনের মধ্য দিয়ে কৌশলগত কিয়াকফিউ বন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে জড়িত, যা বেইজিংকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার দেয়। ভারতও এ অঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয়। আর যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রভাব ঠেকাতে বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে পশ্চিমমুখী করতে চাচ্ছে। যদি এই করিডোর পশ্চিমা সহায়তার প্রবেশপথে পরিণত হয়, তবে আঞ্চলিক টানাপোড়েন আরও বেড়ে যেতে পারে।

তাছাড়া, কক্সবাজারে অবস্থানরত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বিষয়টি ভুলে যাওয়া চলবে না। করিডোর হয়তো তাদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানকে স্বাভাবিক করে তুলবে। রাখাইনে সহায়তা পৌঁছানোর দৃশ্য যদি বাস্তুচ্যুতি নিরসনের পরিবর্তে সংকট ব্যবস্থাপনার বার্তা দেয়, তাহলে আন্তর্জাতিক চাপ কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। বরং এটি সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করার ঝুঁকি বাড়াবে।

আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো, এই করিডোর হয়তো নতুন বাস্তুচ্যুতদের উৎসাহিত করতে পারে। যদি সীমান্ত পেরুলেই সহায়তা মিলবে এমন ধারণা ছড়ায়, তাহলে এই করিডোরই পরিণত হতে পারে নতুন শরণার্থীদের প্রবেশপথে। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে সতর্ক করেছে—রাখাইনে দুর্ভিক্ষ ও সংঘাত আরও মানুষকে বাংলাদেশমুখী করে তুলতে পারে।

ঢাকা করিডোরের ওপর কিছু শর্ত আরোপ করেছে ঠিকই, কিন্তু তা এখনও অজানা। জনসমক্ষে না আনলে এসব শর্তের বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। “শর্তগুলো কী? বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো কারা? প্রস্থান কৌশল কী?” এসব কোনো প্রান্তিক কাগুজে প্রশ্ন নয়—এগুলো বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার নিরাপত্তাকবচ।

তাহলে করণীয় কী? প্রথমত, বাংলাদেশকে অবশ্যই জাতিসংঘের পাশাপাশি চীন, ভারত ও আসিয়ানসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অংশগ্রহণে একটি বহুপক্ষীয় কাঠামোর ওপর জোর দিতে হবে—যাতে করিডোর অস্ত্র পরিবহনের রুটে পরিণত না হয়। দ্বিতীয়ত, করিডোরের কার্যক্রম নির্ভর করতে হবে সুনির্দিষ্ট পরিমাপক সূচকের ওপর—স্বচ্ছতা, তৃতীয়পক্ষীয় পর্যবেক্ষণ ও কার্যকর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের রূপরেখা। তৃতীয়ত, সরকারের উচিত বিষয়টি জনসমক্ষে নিয়ে আসা। গোপনে নেওয়া নিরাপত্তা সিদ্ধান্তগুলো পরে গুরুতর পরিণতি ডেকে আনে।

সবচেয়ে জরুরি হলো—বাংলাদেশ যেন এই ভূ-রাজনৈতিক দাবার খেলায় কৌশলগত দাবার গুটি হয়ে না পড়ে। মানবিক করিডোর হয়তো জীবনের জন্য দরজা খুলবে, কিন্তু তার বিনিময়ে যদি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেটি হবে এক করুণ পরিণতি।

মানবিকতা কোন দুর্বলতা নয়। কিন্তু যখন তা ভূ-রাজনীতির সঙ্গে মিশে যায়, তখন তা বাস্তবতার কঠিন বোধ নিয়ে পরিচালিত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশ আজ যে সহানুভূতির নজির দেখিয়েছে, তা প্রশংসনীয় ঠিকই, তবে এখন সময় এসেছে হিসেব করে এগোনোর। তা না হলে, আজকের মহৎ পদক্ষেপ আগামী দিনের নীরব বিপর্যয়ে পরিণত হতে পারে।



এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :

১. দৈনিক সংবাদ, বাংলাদেশ : ০৪ মে,২৫

No comments:

Post a Comment