Tuesday, 24 June 2025

ইসরায়েলের পারমাণবিক শক্তি প্রশ্নে নীরবতা কেন?

এম এ হোসাইন,

বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে প্রতিবছর ব্যয় হয় শত শত কোটি ডলার। প্রণয়ন করা হয় চুক্তি, আরোপিত হয় নিষেধাজ্ঞা, নিযুক্ত হন আন্তর্জাতিক পরিদর্শক। এসব আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনের আদর্শ। কিন্তু এই দৃশ্যমান প্রতিশ্রুতির বিপরীতে রয়েছে এক দৃষ্টিকটূ বৈপরীত্য—ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার। দীর্ঘদিন ধরেই এটি একটি ‘ওপেন সিক্রেট’। তবু, বিশ্ব মঞ্চে এর বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হওয়া তো দূরের কথা, বরং এ বিষয়ে এক গভীর, কৌশলগত নীরবতা বজায় রাখা হয়।

যেখানে ইরান, উত্তর কোরিয়া কিংবা অন্য যে কোনও দেশের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের শেষ নেই, সেখানেই ইসরায়েল রয়ে গেছে এক প্রকার অদৃশ্য আশ্রয়ের অন্তরালে। এই বৈষম্যমূলক আচরণ কেবল আন্তর্জাতিক রীতিনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না, বরং পুরো নিরস্ত্রীকরণ প্রচেষ্টাকে একরকম তামাশায় পরিণত করেছে।

ইসরায়েলের পারমাণবিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকের গোড়ায়, যখন গঠিত হয়েছিল ইসরায়েলি পারমাণবিক শক্তি কমিশন। এরপর অতি গোপনে এটি রূপ নেয় পূর্ণাঙ্গ অস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচিতে। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সহায়তায় ইসরায়েল দক্ষিণ নেগেভ মরুভূমিতে নির্মাণ করে ডিমোনা পারমাণবিক চুল্লি। ১৯৬০-এর দশকের শেষ নাগাদ অনেক বিশেষজ্ঞই ধারণা করেন, ইসরায়েল ইতোমধ্যেই পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলেছে।

১৯৮৬ সালে এই গোপন কর্মসূচির প্রথম বড়সড় তথ্য ফাঁস করেন ডিমোনা কেন্দ্রে কর্মরত সাবেক প্রকৌশলী মরদেখাই ভানুনু। তিনি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রসম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য দেন। এর পরপরই তাকে মোসাদ অপহরণ করে রোম থেকে গোপনে ইসরায়েলে নিয়ে আসে, প্রহসনের বিচারে তাকে গোপনে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যার ১১ বছর কাটাতে হয় নির্জন সেলে। এই ঘটনা ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের পারমাণবিক গোপনীয়তায় একটি ফাটল সৃষ্টি করেছিল এবং বহু গোয়েন্দা সংস্থার সন্দেহকে সত্যে রূপ দিয়েছিল।

ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই স্বীকার করেনি যে তারা পারমাণবিক অস্ত্রধারী। কিন্তু স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর মতে, ইসরায়েলের হাতে আনুমানিক ৮০ থেকে ২০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, যার মধ্যে গ্র্যাভিটি বোমা, ভূমি, আকাশ ও সমুদ্রপথে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত। আমেরিকার বিজ্ঞানীদের ফেডারেশনও এই তথ্য সমর্থন করে জানায়, ইসরায়েলের কাছে রয়েছে সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র যা তাকে দ্বিতীয় দফার পারমাণবিক প্রতিঘাত বা "সেকেন্ড-স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি" নিশ্চিত করে। এমনকি কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ইসরায়েল থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র উন্নয়নের পথেও অগ্রসর হচ্ছে।

এই অনানুষ্ঠানিক অথচ সুদূরপ্রসারী পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার একপ্রকার ‘ওপেন সিক্রেট’। অথচ, ইরানের প্রতিটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-র তীব্র নজরদারির আওতায় পড়ে, সেখানে ইসরায়েলের অস্ত্রভাণ্ডার রয়ে যায় অন্ধকারে।

পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রচেষ্টার ভিত্তি। এই চুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে নিরস্ত্রীকরণে অগ্রসর হবে, আর অস্ত্রবিহীন রাষ্ট্রগুলো পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করবে কেবল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে এবং কড়া পরিদর্শনের অধীনে। এই চুক্তির বিধান অনুসারে, ১৯৬৭ সালের আগে যারা পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী ছিল না, তাদের জন্য এমন অস্ত্র তৈরি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি ইসরায়েল এই চুক্তিতে যোগ দিত, তবে তাকে নিরস্ত্রীকরণে বাধ্য করা হতো। কিন্তু চুক্তির বাইরে থেকে, ইসরায়েল তার কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পেরেছে অন্যদিকে, বিশ্বের বাকি দেশগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে মেনে চলতে।

এই বৈপরীত্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন ইরানের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ইরান হলো এনপিটি স্বাক্ষরকারী দেশ, যারা আইএইএ'র নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায় রয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে তাদের কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছে। তবুও, ইরান নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং সর্বশেষে ইসরায়েলি বাহিনীর অবৈধ সামরিক আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়েছে। অপরদিকে, ইসরায়েল পায় বছরে ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মার্কিন সহায়তা, সামরিক সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সুরক্ষা।

১৯৬৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোলদা মেয়ারের মধ্যে একটি মৌখিক সমঝোতা হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েল তার পারমাণবিক অস্ত্র রাখবে, তবে তা প্রকাশ করবে না বা প্রকাশ্যে পরীক্ষা চালাবে না। সেই থেকে এই ‘পারমাণবিক নীরবতা নীতি’ অনুসরণ করে আসছে সব মার্কিন প্রশাসন। ইসরায়েল পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র, তবু তারা পর্দার আড়ালে, অথচ সমগ্র অঞ্চলের নিরাপত্তা কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই দৃষ্টান্ত কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক দ্বৈতনীতির নয়, বরং তাদের আঞ্চলিক কৌশলগত অবস্থানেরও প্রমাণ। যুক্তরাষ্ট্র চায়, মধ্যপ্রাচ্যে শুধু তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের হাতেই পারমাণবিক ক্ষমতা থাকুক। এই বৈষম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পুরো অঞ্চলকে ঠেলে দিয়েছে এক বিপজ্জনক প্রতিযোগিতার দিকে।

ইসরায়েলের একচ্ছত্র পারমাণবিক সক্ষমতা একটি নতুন প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে। সৌদি আরব স্পষ্টভাবে বলেছে—ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তারাও পিছিয়ে থাকবে না। মিসর বহুবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এই বিষয়ে। মধ্যপ্রাচ্যকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব বহুবার এসেছে জাতিসংঘে, কিন্তু প্রতিবারই তা ভেস্তে গেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বাধায়।

এই পরিস্থিতিতে অঞ্চলের প্রতিটি ভুল পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে সর্বনাশা। ভুল তথ্য, সাইবার হামলা, কিংবা রাজনৈতিক উত্তেজনা যেকোনো সময় গড়াতে পারে পূর্ণমাত্রার পারমাণবিক সংঘর্ষে। এমনকি, ‘সেকেন্ড-স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি’-র মালিক ইসরায়েল যদি মনে করে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকিতে, তবে প্রতিক্রিয়া আসতে পারে অকল্পনীয় ভয়াবহতায়।

এই বৈশ্বিক নীরবতা শুধু কৌশলগত নয়, এটি এক ভয়ানক নৈতিক বিপর্যয়। যখন বিশ্ব বলে—‘পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ একটি সর্বজনীন আদর্শ’, তখন তা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কিছু রাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র রাখলে তাতে আপত্তি নেই, আবার অন্যরা তা চাইলে তাদের উপর চড়াও হয় গোটা বিশ্ব। এই দ্বৈত মানদণ্ড যদি চলতেই থাকে, তবে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে নিরস্ত্রীকরণ বার্তা আর গ্রহণযোগ্য থাকবে না। তখন ইরান, সৌদি আরব, এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক রাষ্ট্র এই প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হবে—আমরা কেন নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখব?

বর্তমানে পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ হয়তো অবাস্তব। কিন্তু প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে স্বচ্ছতা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলকে বাধ্য করতে পারে তাদের অস্ত্রভাণ্ডারের অস্তিত্ব স্বীকার করতে। এরপর শুরু হতে পারে একটি বাস্তবসম্মত আলোচনার ধারা যেখানে আঞ্চলিক দেশগুলো একত্রে বসে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল গঠনের রূপরেখা তৈরি করবে। এটি শুধু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নয়, আস্থার ভিত্তি তৈরি করবে। একটি সুষম ও ন্যায়ভিত্তিক নিরাপত্তা কাঠামো প্রতিষ্ঠার পথে এটি হবে প্রথম ধাপ। নয়তো বর্তমান অবস্থা শুধু আরও বড় সংকটের জন্ম দেবে।

ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে যে বিশ্বব্যাপী নীরবতা রয়েছে, তা নিছক কূটনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা নয়, এটি এক সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত জন্ম দিয়েছে বৈশ্বিক দ্বৈতনীতি, আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং নৈতিক পরাজয়ের। এই নীরবতার মূল্য দিতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা, আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে। তাই, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সত্যিকার অর্থে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তবে এখনই সময়—এই দ্ব্যর্থতার অবসান ঘটিয়ে, এক ন্যায্য ও সমতা-ভিত্তিক পারমাণবিক নীতি প্রতিষ্ঠা করার।


লেখক: রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।


   এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :

১. সময়ের আলো, ঢাকা : ২৫ জুন, ২৫

No comments:

Post a Comment