Sunday, 29 June 2025

যুদ্ধবিরতি: শান্তির সম্ভাবনা নাকি সাময়িক নিস্তব্ধতা

এম এ হোসাইন,

মধ্যপ্রাচ্য আবারও ভয়াবহ বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। টানা বারো দিন ধরে গোটা বিশ্ব শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, যখন ইরান ও ইসরায়েল পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী হামলা চালায়। এই পাল্টাপাল্টি আক্রমণ দু’দেশ এবং তাদের মিত্রদের এক ভয়, ধ্বংস এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ শক্তিপরীক্ষার চক্রে ঠেলে দিয়েছিল। ক্ষয়ক্ষতি কেবল প্রাণহানি বা ভবন ধ্বংসে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে নাড়িয়ে দেয় এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সৃষ্টি করে। কূটনীতি ব্যর্থ হলে সেখানে সহিংসতা তার স্থান দখল করে নেয়—এটি তারই এক নির্মম স্মারক হয়ে রইল।

সবকিছুর সূচনা হয় ১৩ জুন, যখন ইসরায়েল “অপারেশন রাইজিং লায়ন” নামে ইরানে একটি অন্যায্য আকস্মিক হামলা চালায়। বিমান হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা এবং উচ্চ-মূল্য মানবিক লক্ষ্যবস্তু। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এই হামলাকে যৌক্তিক দাবি করে বলেন, ইরান নাকি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। দীর্ঘদিন পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির সদস্য থাকা ইরান জোর দিয়ে জানায়, তাদের পরমাণু কর্মসূচি কেবল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। ইসরায়েলি সামরিক হস্তক্ষেপের পর, তেহরান দ্রুত জবাব দেয়। “অপারেশন ট্রু প্রমিস” নামে ইরান ইসরায়েলি অবকাঠামোয় ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।

তৃতীয় দিনেই দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা রূপ নেয় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে, যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়। মার্কিন বি-২ বোমারু বিমান এবং “বাংকার বাস্টার” নামের শক্তিশালী বোমা ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক কেন্দ্রে আঘাত হানে। পাল্টা জবাবে ইরান কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলার হুমকি দেয়।

আর যখন এই সংঘাতের ঘূর্ণি পুরো অঞ্চলকে—বেইরুত থেকে বাগদাদ, দোহা থেকে দুবাই পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলতে চলেছে, তখনই ঘটল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইরানে ‘শাসন পরিবর্তন’-এর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, হঠাৎ করেই সুর পাল্টান। তিনি প্রকাশ্যে শান্তির আহ্বান জানান এবং উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতির পথে এগোতে অনুরোধ করেন। আরও উল্লেখযোগ্য হলো, তিনি  কাতারের আমিরকে তেহরানের সঙ্গে মধ্যস্থতা করতে অনুরোধ করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে। যদিও এটি ভঙ্গুর এবং ইতোমধ্যে পক্ষদ্বয়ের পরস্পরবিরোধী লঙ্ঘনের অভিযোগে চ্যালেঞ্জের মুখে, তবে আপাতত হামলা-পাল্টা হামলা বন্ধ রয়েছে।

এই বারো দিনের যুদ্ধে শত শত ইরানির মৃত্যু হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছেন বহু ইসরায়েলিও। অসংখ্য পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়েছে, নগরবাসী আতঙ্কে দিন কাটিয়েছে। ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, আর ইসরায়েল, তার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম এতো বেশি হুমকি ও ক্ষতির সম্মুখীন হলো। ইসরায়েলের বসবাসকারী ইহুদি নাগরিকদের দেশ ত্যাগের হিড়িক উঠেছে। পাশ্ববর্তী দেশ, সাইপ্রাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসরায়েলি ইহুদি জনগোষ্ঠী স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য জমি, ফ্ল্যাট কেনার ধুম লেগেছে যা সাইপ্রাসের স্থানীয় রাজনীতিতে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

এই সংঘাত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এই অঞ্চলের রাজনৈতিক বাস্তবতা কতটা বিস্ফোরণোন্মুখ। ইরান মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করতে চায়, ইসরায়েল আত্মরক্ষার নামে ইরান কে দমিয়ে রাখতে চায়, আর যুক্তরাষ্ট্র বারবার নিজের অবস্থান বদলায়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু যা দশকের পর দশক ধরে অমীমাংসিত। এসব মিলিয়ে টেকসই শান্তি এখানে এখনো সুদূরপরাহত।

যদি এই সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতিকে কোনভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করতে হয়, তাহলে তা হবে শুরু হিসেবে—স্থায়ী শান্তির দিকে প্রথম দুর্বল কিন্তু জরুরি পদক্ষেপ।

আরও এক ধাপ অগ্রসর হলে এই সংঘাতের ফলাফল হতে পারত অকল্পনীয়। যুদ্ধ হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়ার হুমকি সৃষ্টি করেছিল—যে পথ দিয়ে বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ তেল পরিবাহিত হয়। এতে করে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে আগেই দাম হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল, এবং এক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের তেলে নির্ভরশীল দেশগুলো, যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, এমনকি জাপানের জন্যও এ ধরনের সংকট হতো বিধ্বংসী। মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি ঘাটতি, এবং সামাজিক অস্থিরতা—এসব আর কল্পনার বিষয় নয়, বরং বাস্তব ঝুঁকি হয়ে দরজায় কড়া নাড়ছিল।

অর্থনীতির বাইরে মানবিক ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও দ্রুত বিস্তৃত হতো। প্রায় ৯ কোটি মানুষের দেশ ইরান এবং ৯০ লাখ জনসংখ্যার ইসরায়েল শুধু শত্রুপক্ষ নয়, এই দেশগুলোর প্রতিটি কোণে আছে পরিবার, বিদ্যালয়, প্রবীণ নাগরিক ও শিশু। উভয় সমাজেই আছে লাখ লাখ শান্তিকামী মানুষ, যাদের কোনো ভূমিকা ছিল না সেই সিদ্ধান্তগুলোতে যা তাদের ধ্বংসের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এই সাধারণ মানুষের স্বার্থেই শান্তিকে একটি ক্ষণিক বিরতি নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত লক্ষ্য হিসেবে নিতে হবে।

তবে বাস্তবতা অনেক কঠিন। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা যতটা সহজ, বাস্তবায়ন ততটাই জটিল, বিশেষ করে যখন উভয় পক্ষ আদর্শগতভাবে একে অপরকে প্রতিরোধ কিংবা ধ্বংসের পথেই পরিচালিত করতে চায়। ইরান এখনো লেবাননের হেজবুল্লাহ থেকে শুরু করে ইয়েমেন, গাজা, ইরাক ও সিরিয়ার মিলিশিয়াদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধিবিরতির পরবর্তী সময়ে, ইরান তার সামরিক শিল্পাঞ্চল ইয়েমেনে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।  আর ইসরায়েল প্রায়শই অনাকাঙ্ক্ষিত আগ্রাসন, অবৈধ দখলদারিত্ব ও আগাম হামলাকে প্রতিরোধের বৈধ কৌশল বলে ধরে নেয় এবং তা সবসময়ই আন্তর্জাতিক কোনো জবাবদিহি ছাড়াই চালিয়ে যায়। এর পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্যের উল্লেখযোগ্য সুন্নি প্রধান দেশ গুলোর সরকারদের নিজের বলয়ে রেখে আঞ্চলিক অস্থিরতা জিইয়ে রেখেছে।

এর মধ্যেই ফিলিস্তিন সমস্যাকে বারবার অবহেলিত  করে রাখা হয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশা সমাধান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি কেবল মরীচিকা। গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি আগ্রাসন, অবরোধ, বসতি সম্প্রসারণ, ও বেসামরিক হতাহতের চিত্র গোটা আরব ও মুসলিম বিশ্বকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ফিলিস্তিন, ইরানের কাছে একটি ন্যায়সঙ্গত প্রতিরোধের প্রতীক তবে, এর আড়ালে তারা নিজের আঞ্চলিক অবস্থান শক্তিশালী করে তুলতে চাইছে।

যদি ইসরায়েল সত্যিকার অর্থে শান্তি চায়, তাহলে কেবল পরমাণু স্থাপনায় বোমাবর্ষণ নয়, বরং সহাবস্থানের সদিচ্ছা প্রমাণ করতে হবে। তাদের অবরোধ শেষ করতে হবে, অবৈধ দখলদারিত্ব বন্ধ করতে হবে, এবং ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার স্বীকার করতে হবে। কারণ শত্রুর কণ্ঠরোধ নয়, বরং তার প্রতিবাদের কারণ দূর করলেই আসবে নিরাপত্তা।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। ট্রাম্পের আচমকা মনোভাব পরিবর্তন, যেমন একদিকে শাসন পরিবর্তনের ডাক অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান যা আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যনীতি কতটা দোদুল্যমান, তা স্পষ্ট করে। একই সঙ্গে এটিও প্রমাণ করে যে, ওয়াশিংটন চাইলে এখনো পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে পারে এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। দশকজুড়ে তারা অস্ত্র বিক্রি, আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ, জাতিসংঘে ভেটো এবং ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা ছড়িয়েছে। কিন্তু চাইলে সেই আমেরিকাই হতে পারে ন্যায়বিচারের মধ্যস্থতাকারী।

এই মুহূর্তে প্রয়োজন বৈশ্বিক কোনো রাজনৈতিক নয়, নৈতিক নেতৃত্ব। যে নেতৃত্ব বোমার শব্দ নয়, কূটনীতির কণ্ঠস্বরকে প্রাধান্য দেয়। যে মানুষকে সংখ্যা নয়, প্রাণ বলে বিবেচনা করে। ইসরায়েল যেন সংঘর্ষ পুনরায় শুরু করার পায়তারা না করে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের প্রলোভনে না ফেলতে পারে তার প্রতি বৈশ্বিক নেতৃত্বকে সোচ্চার হতে হবে। আর ইরানকেও দেখাতে হবে সংযম ও দূরদর্শিতা। যুক্তরাষ্ট্র, যেই হোক হোয়াইট হাউসে—তাদের উচিত হবে অন্ধভাবে পক্ষাবলম্ভন না করে, সমাধানের পক্ষে দাঁড়ানো।

এই যুদ্ধবিরতি যেন কেবল একটি সাময়িক সমঝোতা না হয়। বরং এটি হোক এক নতুন মধ্যপ্রাচ্যের সূচনা—যেখানে স্থায়ী যুদ্ধ নয়, বরং কঠিন, ধৈর্যশীল এবং সৎ সংলাপ হবে প্রধান ভিত্তি। কারণ বিকল্প পথটি—অর্থাৎ ক্ষেপণাস্ত্রের গর্জন, সাইরেনের আর্তনাদ, এবং কফিনের সারি—শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয়, তা মানবতা-বিরোধী।

ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধ বিমানের গর্জন স্তব্ধ হয়েছে। এখন যুক্তি ও ন্যায্যতার কণ্ঠস্বর গর্জে  উঠুক। শান্তিকে, তা যতই ভঙ্গুর হোক না কেন অন্তত একবার স্থায়ী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক।



লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। 


  এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :

১. সময়ের আলো, ঢাকা : ৩০ জুন,২৫

No comments:

Post a Comment