এম এ হোসাইন,
গত ২৭ মে, কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম আসিয়ান-জিসিসি-চীন অর্থনৈতিক সম্মেলন—চকচকে কূটনীতির এক প্রদর্শনী, যেখানে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা আর অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতির বাহার ছিল। তাত্ত্বিকভাবে এটি একটি কৌশলগত মোড় ঘোরানোর ইঙ্গিত—এক অনিশ্চিত যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতা থেকে সরে এসে অর্থনৈতিক বাস্তবতানির্ভর বহু-মেরুকেন্দ্রিক এক গঠনের দিকে। কিন্তু বাস্তবে, চকচকে নির্ভুল ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ানোর মত এটি মোড় পরিবর্তনের চেয়ে বরং একটি চক্রাকার আবর্তন হতে পারে— যা একই জায়গায় স্থির থাকে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, যিনি এই সম্মেলনের রূপকার এবং দিনদিন প্রভাবশালী আঞ্চলিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন।তিনি বিশ্বাস করছেন চীন ও উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের(জিসিসি) সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা আসিয়ান-এর অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য হতে পারে একযোগে দিকনির্দেশক কম্পাস, আবার সম্ভাব্য উত্তরণের রক্ষা-কুঠি। তাঁর বক্তব্যে দৃঢ়তা রয়েছে। তাঁর যুক্তি সুসংহত। সময় নির্বাচনও কৌশলগত।
তবু প্রশ্নটা উঠেই যায়: আসিয়ান কি নিজের অবস্থানকে অতিরিক্ত মূল্যায়ন করছে? এই সম্মেলনের তাৎপর্য বুঝতে গেলে আগে জানতে হবে এটি কী প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে। এক সময় যে মুক্তবাণিজ্য ছিল ওয়াশিংটনের ধর্মীয় মতবাদের মতো, এখন তা হয়ে উঠেছে জনতাবাদী রাজনীতির বলিপাঁঠা। ট্রাম্প ২.০ যুগে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে আরোপ করেছে ব্যাপক শুল্ক যা ‘লিবারেশন ডে’ ট্যারিফ নামে পরিচিত। চীনা পণ্যের ওপর আর দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় রপ্তানির ওপর বিস্তৃতভাবে প্রভাব ফেলছে, কোথাও তা ৪৯ শতাংশ পর্যন্তও পৌঁছেছে। এতে করে তার বার্তা পরিষ্কার: আন্তর্জাতিক নিয়ম শৃংখলার যুগ শেষ, মিত্রতা ঐচ্ছিক। যারা জিতবে, তারাই নিয়ম লিখবে।
এই ভূরাজনৈতিক ঝড়ঝঞ্ঝা আসিয়ানকে বিকল্প সন্ধানে ঠেলে দিয়েছে। বাস্তবতাবাদী আনোয়ার আসিয়ানকে কেবল একটি আঞ্চলিক সংস্থা নয়, বরং গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন—এক এমন বিশ্বে যেখানে ঐতিহ্যগত মিত্রতার জৌলুস ম্লান। তাই এই ত্রিপাক্ষিক সম্মেলন প্রথমত একটি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ঘোষণা।
তবে কাঠামোগত ভিত্তি ছাড়া সে কর্তৃত্ব কেবল মরীচিকা। আসিয়ান, চীন এবং জিসিসির মধ্যে অর্থনৈতিক সংযুক্তির ধারণা অবাস্তব নয়—বরং বেশ আকর্ষণীয়। গত বছর আসিয়ানের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য দাঁড়িয়েছে ৭০০ বিলিয়ন ডলারে; জিসিসির সঙ্গে এই পরিমাণ কম হলেও তা ক্রমবর্ধমান—বিশেষত জ্বালানি, আর্থিক পরিষেবা ও লজিস্টিক খাতে। চীনা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) আসিয়ানে পৌঁছেছে ১৭.৭ বিলিয়ন ডলারে; আর জিসিসি-ভিত্তিক বিনিয়োগ ২০১৮ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
তাত্ত্বিকভাবে, এই তিনটি অঞ্চল পরস্পর পরিপূরক শক্তি নিয়ে আসে। আসিয়ান সরবরাহ করে শ্রমশক্তি ও ভোক্তা বাজার, চীন দেয় বিশাল উৎপাদন ক্ষমতা ও পরিসরের সুবিধা, আর জিসিসি নিয়ে আসে মূলধন ও জ্বালানি সম্পদ। এদের একত্র করলে গঠিত হয় এক বিশাল বলয়—দুই বিলিয়নের বেশি জনসংখ্যা এবং মোট ২৩.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্মিলিত জিডিপি-সহ এক ভয়ংকর অর্থনৈতিক শক্তি।
কিন্তু অর্থনৈতিক যুক্তি আর রাজনৈতিক ঐক্য এক জিনিস নয়। জিসিসি নিজেকে একটি ঐক্যবদ্ধ বলয় হিসেবে উপস্থাপন করলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০১৭ সালের কাতার অবরোধ থেকে শুরু করে গাজা ও ইরান নিয়ে ভিন্নমুখী নীতি—জিসিসি-ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্য সহযোগিতার চেয়ে অনেক বেশি। সৌদি আরবের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনৈতিক অভিযাত্রা, কাতারের গ্যাস-কেন্দ্রিক কূটনীতি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মূলধনভিত্তিক নীতিমালা, বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে স্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক।
চীন, তার পক্ষ থেকে, নীতিগতভাবে বহুপাক্ষিকতাকে সমর্থন করে না, যদি না তাতে স্বার্থ জড়িত থাকে। প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এবং “বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা অপসারণ”-এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করলেও, বেইজিং কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এটি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বাদ পড়া নয়—বরং পরিকল্পিত কৌশল। চীন দ্বিপাক্ষিকতাকে বেশি প্রাধান্য দেয় তবে ত্রিপাক্ষিক কাঠামো তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য সহায়ক হলে সমর্থন করে, কিন্তু এটি কখনোই মূল লক্ষ্য নয়।
অন্যদিকে, আসিয়ান প্রতিষ্ঠানগতভাবে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণে একপ্রকার অক্ষম। আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দশ বছর লেগে গেছে। এর অর্থনৈতিক একীভূকরণের লক্ষ্য এখনো কেবল প্রত্যাশার স্তরেই রয়ে গেছে—বিধিনিষেধে বড় ধরনের অমিল ও বাস্তবায়নে কার্যত কোনো বলপ্রয়োগ নেই। মিয়ানমার সংকটের মতো গুরুতর রাজনৈতিক ইস্যুতেও আসিয়ানের প্রতিক্রিয়া ছিল সবসময় অকার্যকর।
ত্রিপাক্ষিক জোট কথায় যতটা আকর্ষণীয় শোনায়, বাস্তবে তার ভিত্তি ততটাই দুর্বল—এর নেই কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি, নেই বিরোধ নিষ্পত্তির কাঠামো, এমনকি নেই বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা। এটি কেবল কাগজে-কলমে সহযোগিতা, বাস্তবতায় নয়।
তবে এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য কুয়ালালামপুর শীর্ষ সম্মেলনের কূটনৈতিক গুরুত্বকে খাটো করা নয়। প্রতীকী বার্তা বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ, এবং আসিয়ান নিজেকে পূর্ব এশীয় আঞ্চলিকতার সীমানা ছাড়িয়ে প্রভাবশালী এক ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করে একধরনের কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে। এই সম্মেলনে একটি বাস্তবতা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে যা ওয়াশিংটনে প্রায়ই উপেক্ষিত হয়—গ্লোবাল সাউথ এখন আর ভৌগোলিক রাজনীতির উপেক্ষিত কোন তাৎপর্যহীন খেলোয়াড় হয়ে থাকতে চায় না।
তবে প্রতীকী সাফল্যকে শেষ পর্যন্ত বাস্তব কার্যকরীতার পথেই নিয়ে যেতে হবে। এখানে মূল ঝুঁকিটি হল কৌশলগত অতিরঞ্জন—দৃষ্টিনন্দন আয়োজনকে বাস্তব অর্জন মনে করা, আর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিকে নীতিনির্ধারণের প্রতিফলন হিসেবে দেখা। আসিয়ানের জন্য বিপদ হল, এই জোট নিজস্ব বর্ণনাচর্চারই বন্দি হয়ে পড়তে পারে। একটি এমন বলয়, যা একত্রীকরণের কথা বলে, অথচ সার্বভৌমত্ব ও ঐকমত্যনির্ভর রাজনীতির সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থেকে যায়।
এই বাস্তবতা আরও জটিল ও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যখন অংশীদার হিসেবে চীন ও জিসিসি’র মতো অত্যন্ত কৌশলী ও জটিল খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। উভয় অংশীদারই কেন্দ্রীভূত এবং প্রায়শই ব্যক্তিনির্ভর সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ার মধ্যে কাজ করে থাকে। তাদের জাতীয় স্বার্থ ব্যতীত বহুপাক্ষিক প্রতিশ্রুতি মেনে চলার কোনও দুর্দান্ত রেকর্ড নেই।
যদি এই শীর্ষ সম্মেলন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হয়ে থাকে, তবে তা বোধগম্য—কিন্তু তা অবশ্যই চ্যালেঞ্জ সাপেক্ষ। আনোয়ার ইব্রাহিমের ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে আসিয়ান-যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ বৈঠকের আমন্ত্রণ জানানো চিঠি প্রমাণ করে যে আসিয়ান এখনো ওয়াশিংটনের প্রতি দরজা পুরোপুরি বন্ধ করেনি। তবে সেই দরজার ওপাশ থেকে এখন ক্রমশই সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে।
জনমত জরিপগুলো এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে যে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন লেনদেনভিত্তিক কূটনীতির সবচেয়ে আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন যদিও বক্তব্যে বহুপাক্ষিকতার পক্ষে ছিলো, কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নিয়ে তার কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অস্পষ্ট ও লক্ষ্যহীন। ফলে, আসিয়ান আজ নিজেকে এক অনির্ভরযোগ্য বিশ্বে একা দাঁড়িয়ে থাকা, অবলম্বনহীন এক বলয় হিসেবে অনুভব করছে—যার পাশে কোনো নির্ভরযোগ্য শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক নেই।
তবুও, ওয়াশিংটন খেলার বাইরে নয়। আসিয়ানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য—ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন—কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। এদের কেউ কেউ সামরিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও গভীর করছে। পরিস্থিতি জটিল হলে এ দেশগুলো আসিয়ান ঐকমত্যের চেয়ে নিজেদের জাতীয় স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেবে। এটি অনুমান নয়, বাস্তবতা।
এখানেই শীর্ষ সম্মেলনের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী দাবিটি হলো যে ত্রিপাক্ষিক কাঠামো একটি নতুন অর্থনৈতিক মেরুতে রূপ নিতে পারে। যেখানে আসিয়ান এক কণ্ঠে কথা বলতে পারে না, সেখানে এত বৃহৎ মঞ্চে এক থাকাটা বেশ কঠিন।
যা বলার মতো, আনোয়ার ইব্রাহিম ধীরগতির এক প্রতিষ্ঠানে গতি ও জরুরি ভাবনার সঞ্চার করেছেন। তিনি আসিয়ানকে বৈশ্বিক বিপর্যয়ের নীরব ভুক্তভোগী নয়, বরং বিশ্ব বাণিজ্যে একটি সক্রিয় ও প্রভাবশালী অংশগ্রহণকারী হিসেবে কল্পনা করে একটি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। এটি কোনো সামান্য সাফল্য নয়।
কিন্তু নেতৃত্বের প্রকৃত পরীক্ষা প্রশংসা কুড়ানোর ক্ষমতায় নয় বরং স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলার সক্ষমতায়। ত্রিপাক্ষিকতা আসিয়ানের অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সংস্কারের বিকল্প হতে পারে না। যদি এই বলয় ২০৪৫ সালের মধ্যে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠতে চায়—যেমন কিছু পূর্বাভাসে বলা হয়েছে—তবে তাকে আনুষ্ঠানিকতা কমিয়ে, বাস্তব নীতিনির্ধারণে আরও মনোযোগ দিতে হবে।
এই শীর্ষ সম্মেলন কোনো ভুল ছিল না। তবে আসিয়ান যদি চায় যে এটি যেন একটি এককালীন প্রদর্শনীতে পরিণত না হয়, তাহলে তাকে কঠিন কিন্তু অপরিহার্য কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। আর তাহলো বাধ্যতামূলক কাঠামো নির্মাণ, নীতিমালার মান একীকরণ, এবং নিয়ম প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ। আসিয়ানকে বেছে নিতে হবে—একত্রীকরণের পথ, নাকি স্থবিরতার অভ্যস্ত গতি।
আসল বিপদ এই নয় যে আসিয়ান বড় স্বপ্ন দেখছে। বরং বিপদ এই যে, একসময় হয়তো জেগে দেখবে—বিশ্ব এগিয়ে গেছে অনেক দূর, আর পেছনে রয়ে গেছে এমন একটি অঞ্চল, যার বক্তব্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভরপুর, কিন্তু দৃঢ়তা প্রায় নেই বললেই চলে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :
১. আলোকিত বাংলাদেশ, ঢাকা : ০৩ জুন, ২৫
No comments:
Post a Comment