Wednesday, 2 July 2025

ট্রাম্পের মন্তব্যে ইউরোপের নিরাপত্তা বিভ্রম

এম এ হোসাইন,

দ্য হেগ-এ অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক ন্যাটো সম্মেলনে যোগদানের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটিমাত্র মন্তব্য মাসের পর মাস ধরে চলা কৌশলগত পরিকল্পনাকে ছাপিয়ে গেল। এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকরা যখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি এখনো ন্যাটোর সম্মিলিত প্রতিরক্ষা নিশ্চয়তা সংবলিত অনুচ্ছেদ-৫ এর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন—জবাবে ট্রাম্প অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে বললেন, “আপনার সংজ্ঞার উপর নির্ভর করে।” এ যেন ট্রাম্পের কৌশলের সেই পুরোনো দৃশ্য—সুক্ষ্ম উস্কানি, দ্ব্যর্থতা, এবং আত্মরক্ষার রাস্তা খোলা রাখা।

এই মন্তব্যকে কেবল আরেকটি ‘কূটনৈতিক ভুল’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবে, ট্রাম্প পশ্চিমা প্রতিরক্ষা কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে এক গুরুতর প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন। অনুচ্ছেদ-৫ কোনো সাধারণ চুক্তির ধারা নয়। এটাই সেই প্রতিশ্রুতি, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আট দশক ধরে আটলান্টিকের দুই প্রান্তের মিত্রতাকে সংহত রেখেছে। এই ভিত্তিই যদি প্রশ্নের মুখে পড়ে, তাহলে পুরো কাঠামোটা ভেঙে পড়ুক আর না পড়ুক, এর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

ট্রাম্প এই মন্তব্যটি করেছেন একটি ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে, যার সূচনা হয়েছিল তার প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় । তিনি একাধিকবার ন্যাটোকে “অপ্রাসঙ্গিক” বলে আক্রমণ করেছেন, মিত্র দেশগুলোর সামরিক ব্যয় না বাড়ানো নিয়ে ভর্ৎসনা করেছেন এবং কখনো কখনো পুরো জোট থেকে সরে আসার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। যদিও সে সময় তা বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু মিত্র রাষ্ট্রগুলো তা ভুলে যায়নি। এখন দ্বিতীয় মেয়াদে এসে ট্রাম্প যেন সেই পুরোনো স্ক্রিপ্ট আবার চালু করেছেন—এইবার আরেকটু বেশি কঠোরভাবে।

ন্যাটোর ইতিহাসে একবারই অনুচ্ছেদ-৫ প্রয়োগ করা হয়েছিল - ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর, যখন আমেরিকাই ছিল হামলার শিকার। তখন বাকি সব মিত্র দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে আমেরিকার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সেই দৃশ্যপট ছিল ন্যাটোর প্রতিশ্রুতির এক শক্তিশালী প্রমাণ। এখন যদি এই প্রতিশ্রুতির ব্যাখ্যা নিয়েই সন্দেহ উত্থাপিত হয়, তাহলে যারা এই নিরাপত্তার উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে—বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো, তাদের মধ্যে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়াটা স্বাভাবিক।

অবশ্যই, ট্রাম্প সমর্থকদের বলার মতো যুক্তি আছে। তারা বলে, শীতল যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, ইউরোপ অনেক দিন ধরেই আমেরিকার নিরাপত্তা ছায়ায় থেকে সুবিধা নিয়েছে, এখন মিত্র দেশগুলোর উচিত নিজেদের বোঝা নিজেরা বহন করা। কিছুটা অংশে তারা ঠিকও বটে। ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যরা প্রায়ই কৌশলগত নিষ্ক্রিয়তার জন্য নিজেরাই দায়ী। তারা সন্তুষ্ট থেকেছে এই ভেবে যে, আমেরিকাই খরচ বহন করবে, আর তারা মনোযোগ দেবে কল্যাণ রাষ্ট্র ও সবুজ জ্বালানির পথে রূপান্তরের দিকে।

কিন্তু একজন দায়িত্বশীল নেতা কখনো নীতি সংশোধনের জন্য পুরো মানচিত্রে আগুন লাগিয়ে দেন না। ট্রাম্পের মন্তব্য কৌশলগত প্রণোদনা নয়, বরং তা উগ্র জাতীয়তাবাদের আবরণে ছদ্মবেশী হুমকি। এতে মিত্রদের মধ্যে সংস্কারের অনুপ্রেরণা আসে না, বরং প্রতিপক্ষের ভুল হিসাবের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে কী ভয়ঙ্কর ফল হতে পারে। ১৯৩০-এর দশকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যখন ইতালির মুসোলিনি বা রাইনল্যান্ডে হিটলারের আগ্রাসনের মুখে নির্লিপ্ত থাকল, তখন ফ্যাসিস্ট শক্তিরা তাদের আগ্রাসন আরও বাড়ানোর সাহস পেল। সেই যুগের শিক্ষাই বলেছিল—অস্পষ্টতা মানে দুর্বলতা, আর দুর্বলতা মানেই বিপর্যয়ের আমন্ত্রণ।

ট্রাম্পের এই অনুচ্ছেদ-৫ থেকে ভাষাগত পিছু হটা সেই ধরনের বিপজ্জনক সংকেত। পুতিনের কাছে এর মানে, ন্যাটো আর এককাট্টা নয়। বাল্টিক দেশ ও পোল্যান্ডের কাছে এর বার্তা, তাদের নিরাপত্তা এখন ওয়াশিংটনের এক ব্যক্তির মর্জির উপর নির্ভরশীল। এবং বিশ্বব্যাপী এর অর্থ, আমেরিকার প্রতিশ্রুতি এখন আর কৌশলগত নীতি নয়, বরং লেনদেনের বস্তু।

এই মন্তব্যে ইউরোপের নেতাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মার্জ সতর্ক করেছেন, ইউরোপ আর “ফ্রি রাইড” নিতে পারবে না। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, যিনি একসময় ন্যাটোকে “মৃত-মস্তিষ্ক” বলেছিলেন, এবার ট্রাম্পের বক্তব্যকে ইউরোপীয় কৌশলগত স্বনির্ভরতার স্বপক্ষে দলিল হিসেবে দেখছেন। এক সময় আদর্শবাদ বলে অবজ্ঞা করা ইউরোপীয় সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা এখন বাস্তব হয়ে উঠছে।

ট্রাম্পের অনির্ভরযোগ্যতা হয়তো এক অর্থে ইউরোপের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপ মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ নিরাপত্তার ছায়ায় থেকেছে, কিন্তু সেই ছায়ার মূল্য তারা দেয়নি। এখন সময় এসেছে ইউরোপের আত্মনির্ভরতার।

তবে এই আত্মনির্ভরতা শুধু বাজেট বাড়িয়ে অর্জন করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং সেই কঠোর বাস্তববাদ যা ১৯৪৫-এর পর ইউরোপ নিয়মতই এড়িয়ে গেছে। কারণ আজকের বিশ্বে, যেখানে কর্তৃত্ববাদী শক্তিগুলো পুনরুত্থিত, সেখানে কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচার দিয়ে প্রতিরক্ষা হয় না—প্রয়োজন শক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতা।

অন্যদিকে, রাশিয়ার প্রতি ট্রাম্পের নরম বার্তা ইউরোপীয় উদ্বেগকে আরও বাড়িয়েছে। ট্রাম্প যখন ক্রেমলিনের সাথে ব্যাকচ্যানেল চালু রাখেন, বা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এমন একটি সমঝোতার ইঙ্গিত দেন যা রাশিয়ার পক্ষে ঝুঁকে থাকে, তখন বোঝা যায়, তার আমলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থই অগ্রাধিকার পাবে। যেখানে বাইডেন কিয়েভের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ট্রাম্প সেখান থেকে হাত গুটিয়ে নিতে ব্যস্ত।

সমর্থকেরা একে বলে বাস্তববাদ, আর সমালোচকেরা বলেন আত্মসমর্পণ। কিন্তু যেটাই হোক না কেন, এতে ২০২২ সাল থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর যে নৈতিক ও কৌশলগত স্পষ্টতা ছিল, তা দুর্বল হয়ে পড়ে। এর চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক হলো—এটি পশ্চিমা ঐক্যে ফাটল ধরায় এমন এক সময় যখন মস্কো, বেইজিং এবং তেহরান ধীরে ধীরে হলেও একটি কার্যকরী ও প্রভাবশালী বিরোধী জোটে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।

এখানে ন্যাটো সম্মেলনের প্রতীকি গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এই প্রেক্ষাপটে হেগ-এ আয়োজিত ন্যাটো সম্মেলন, যেখানে ঐক্য, আধুনিকায়ন ও ইউক্রেনের সদস্যপদ অর্জনের পথ পরিষ্কার করার কথা ছিল, এখন এক বিভ্রান্তিকর প্রশ্নে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল—“যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের কথা রাখবে?”

শেষ পর্যন্ত, এ প্রশ্ন গিয়ে ঠেকে বিশ্বাসের জায়গায়। সেই বিশ্বাস—যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন সত্ত্বেও আমেরিকা এখনো মুক্ত বিশ্বের নির্ভরযোগ্য নেতৃত্ব বহন করে। বিশ্বাস যে, বিশ্ব যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে ওঠা জোটগুলো এখনো অর্থবহ। এবং বিশ্বাস যে- আবার যদি অনুচ্ছেদ-৫ পরীক্ষার মুখে পড়ে (আর তা একদিন পড়বেই), তখন কোনো দ্বিধা থাকবে না, কোনো শব্দের ব্যাখ্যা খোঁজা হবে না, এবং রাজনৈতিক সুবিধা ও নৈতিক দায়িত্বের তুলাদণ্ডে ওজন করা হবে না।

ন্যাটো’র শক্তি কখনো শুধু অস্ত্রশস্ত্র বা সৈন্যসংখ্যার ওপর নির্ভর করেনি। এর প্রকৃত শক্তি এসেছে সেই নিশ্চিত বিশ্বাস থেকে যে এর সদস্যরা একসঙ্গে দাঁড়াবে—স্বয়ংক্রিয়ভাবে, নিঃশর্তভাবে এবং বিশ্বাসঘাতকতার ভয় ছাড়াই। ট্রাম্পের এই অস্পষ্টতা সেই আত্মবিশ্বাসকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু বাইরের নয়—ভয়ংকর হল সেই সন্দেহ, যেটা আমরা নিজেরাই মনে জায়গা দিই। ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন, এটি নিপুণ দর কষাকষি; কিন্তু ন্যাটো কোনো ব্যবসা চুক্তি নয়। এটি এক রক্তস্নাত বন্ধন, যা সময়ের পরীক্ষায় গড়ে উঠেছে এবং আজকের অস্থির বিশ্বে এখনো অপরিহার্য।

হেগ-এর সম্মেলনকক্ষে যখন ন্যাটো নেতারা আগামী দশকের মধ্যে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তখন তাদের কর্তব্য কেবল এই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা নয়—বরং এমন এক ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়া, যেখানে এই প্রতিশ্রুতি হয়তো সকল সদস্যের পক্ষে আর বজায় রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। ইউরোপকে এখন প্রস্তুত হতে হবে রাজনৈতিকভাবে, সামরিকভাবে এবং নৈতিকভাবে—এক এমন বিশ্ব বাস্তবতার জন্য, যেখানে আমেরিকা হয়তো শুধু বক্তব্যে নয়, বরং নীতিগত অবস্থান ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণেও অনুপস্থিত থাকতে পারে। প্রশ্ন এখন আর এটি নয়—অনুচ্ছেদ-৫ প্রয়োগ করা হবে কি না। প্রকৃত প্রশ্ন হলো—যদি সেই মুহূর্ত আসে, তখন কেউ কেউ আদৌও সেই আহ্বানে সাড়া দেবে কিনা?


লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। 


  এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে : 

১. সময়ের আলো, ঢাকা : ০৩ জুলাই,২৫

ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে নীরবতা

এম এ হোসাইন,

বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় হয়। চুক্তি হয়, নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়, আন্তর্জাতিক পরিদর্শনসহ সবই চলে নিরস্ত্রীকরণের নামে। কিন্তু এসব প্রচেষ্টার মধ্যেও একটি ব্যতিক্রম, যা বিশ্বের সবার চোখ এড়িয়ে যায় আর সেটি হলো ইসরাইলের গোপন পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার। কিন্তু কেন?

ইসরাইল কখনোই স্বীকার করেনি, তারা পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। অথচ সবাই জানে, তারা অনেক আগেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে। ডিমোনা চুল্লির মাধ্যমে ১৯৫০-এর দশকে তারা যে গোপন কর্মসূচি শুরু করেছিল, তা ১৯৮৬ সালে সাবেক প্রকৌশলী মরদেখাই ভানুনুর তথ্যফাঁসের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। তার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ইসরাইলের হাতে রয়েছে অনেকগুলো পারমাণবিক অস্ত্র। এরপর ভানুনুরকে অপহরণ করে ইসরাইলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও আমেরিকান সায়েন্টিস্ট ফেডারেশন জানায়, ইসরাইলের কাছে ৮০ থেকে ২০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, যেগুলো ভূমি, আকাশ এবং সমুদ্রপথে ব্যবহারযোগ্য। এমনকি তারা ‘সেকেন্ড-স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি’ অর্জন করেছে, অর্থাৎ হামলার পর পাল্টা আঘাত হানার সক্ষমতাও তাদের রয়েছে।

অথচ ইরান যখন শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তির জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করলে সেটি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) কঠোর পরিদর্শনের আওতায় পড়ে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয় এবং হামলার শিকার হয়। ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ সমর্থনের পেছনে রয়েছে ১৯৬৯ সালের এক গোপন চুক্তি, যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী গোলডা মেয়ার একটি সমঝোতায় পৌঁছান। এই সমঝোতা অনুযায়ী ইসরাইল পারমাণবিক অস্ত্র রাখবে, কিন্তু তা প্রকাশ করবে না। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা এই নীতিকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে ইহুদি বর্ণবাদী দেশটি ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের নীরবতা শুধু একটি অভ্যন্তরীণ নীতি নয়; বরং এটি এক দীর্ঘস্থায়ী বৈশ্বিক দ্বৈত মানদণ্ড দ্বারা সমর্থিত। পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে বৈশ্বিক চুক্তির ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) দিকে তাকালে দেখা যায়, ইসরাইল এই চুক্তিতে কখনোই স্বাক্ষর করেনি। এই চুক্তির বিধান অনুসারে, ১৯৬৭ সালের আগে যারা পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী ছিল না, তাদের জন্য এমন অস্ত্র তৈরি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি ইসরাইল এই চুক্তিতে যোগ দিত, তবে তাকে নিরস্ত্রীকরণে বাধ্য করা হতো। কিন্তু চুক্তির বাইরে থেকে ইসরাইল তার কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পেরেছে। অন্যদিকে, বিশ্বের বাকি দেশগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে এই চুক্তি মেনে চলতে।

ইসরাইলের মিত্ররা যুক্তি দেন, শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় ইসরাইলের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তার পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা বৈধ। কিন্তু যদি নিরাপত্তাহীনতা কোনো দেশের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বৈধতা দেয়, তবে বৈশ্বিক নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থা অর্থহীন। তাহলে একই যুক্তি কেন তেহরান, রিয়াদ বা কায়রোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না?

এই নীরবতা শুধু নৈতিক দ্ব্যর্থতা সৃষ্টি করে না, বরং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থার ভিতটাই দুর্বল করে দেয়। এনটিপি একটি নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছেÑতা হলো, যারা পরমাণু অস্ত্র ত্যাগ করে, তারা শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তি পাবে এবং যারা অস্ত্রধারী, তারা ধীরে ধীরে নিরস্ত্রীকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। কিন্তু যখন একটি দেশ স্থায়ীভাবে এই নিয়মের বাইরে থাকে, তখন অন্যরা এ ব্যবস্থায় আস্থা হারায়।

এই বোধের অনুপস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। সৌদি আরব ইতোমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছে, যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে তারাও একই পথে হাঁটবে। মিসরও পরমাণু অস্ত্র নিয়ে ইসরাইলের গোপনীয়তা এবং মধ্যপ্রাচ্যকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতির অভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র এই উদ্বেগে কোনো গুরুত্ব দেয়নি।

ফলে, মধ্যপ্রাচ্য এখন বিপজ্জনক এক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে, যা পুরো অঞ্চলকে মহাবিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

এই আশঙ্কার সামনে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে স্বচ্ছতার দাবি তোলা। এটি শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যও জরুরি। যদি বিশ্ব সত্যিকার অর্থে নিরস্ত্রীকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তবে সব দেশের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হতে হবে। আর যদি তা না হয়, তবে বার্তাটি হবে স্পষ্ট - বিশ্বব্যবস্থা নীতি নয়, শক্তির ভিত্তিতে চলে। আর এই চরম পক্ষপাতদুষ্ট নীরবতার খেসারত দিতে হতে পারে সমগ্র মানবজাতিকে।


লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।


এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :

১. আমার দেশ, ঢাকা : ০২ জুলাই,২৫

Tuesday, 1 July 2025

এই যুদ্ধ বিরতি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

এম এ হোসাইন,

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত হয়তো আপাতত থেমেছে, কিন্তু এই যুদ্ধ যে অস্থিরতা ও জটিল প্রশ্ন রেখে গেছে, তা শুধু রাষ্ট্র নয়—বিশ্বব্যাপী ব্যবসা ও নিরাপত্তা কাঠামোর জন্যও গভীর উদ্বেগের। মাত্র বারো দিনে একটি আঞ্চলিক উত্তেজনা পরিণত হয় সরাসরি সামরিক সংঘর্ষে; যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা এবং ইরানের পারমাণবিক ভবিষ্যৎ আবারও সামনে চলে আসে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও এই সহিংসতা মধ্যপ্রাচ্যের ভঙ্গুর বাস্তবতাকে নতুন করে তুলে ধরে যেখানে কূটনীতি ব্যর্থ হলে ধ্বংসই নিয়তি হয়ে ওঠে।

সবকিছুর সূচনা হয় ১৩ জুন, যখন ইসরায়েল “অপারেশন রাইজিং লায়ন” নামে ইরানে একটি অন্যায্য আকস্মিক হামলা চালায়। বিমান হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা এবং উচ্চ-মূল্য মানবিক লক্ষ্যবস্তু। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এই হামলাকে যৌক্তিক দাবি করে বলেন, ইরান নাকি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। দীর্ঘদিন পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির সদস্য থাকা ইরান জোর দিয়ে জানায়, তাদের পরমাণু কর্মসূচি কেবল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। ইসরায়েলি সামরিক হস্তক্ষেপের পর, তেহরান দ্রুত জবাব দেয়। “অপারেশন ট্রু প্রমিস” নামে ইরান ইসরায়েলি অবকাঠামোয় ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।

তৃতীয় দিনেই দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা রূপ নেয় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে, যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়। মার্কিন বি-২ বোমারু বিমান এবং “বাংকার বাস্টার” নামের শক্তিশালী বোমা ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক কেন্দ্রে আঘাত হানে। পাল্টা জবাবে ইরান কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলার হুমকি দেয়।

আর যখন এই সংঘাতের ঘূর্ণি পুরো অঞ্চলকে—বেইরুত থেকে বাগদাদ, দোহা থেকে দুবাই পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলতে চলেছে, তখনই ঘটল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইরানে ‘শাসন পরিবর্তন’-এর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, হঠাৎ করেই সুর পাল্টান। তিনি প্রকাশ্যে শান্তির আহ্বান জানান এবং উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতির পথে এগোতে অনুরোধ করেন। আরও উল্লেখযোগ্য হলো, তিনি  কাতারের আমিরকে তেহরানের সঙ্গে মধ্যস্থতা করতে অনুরোধ করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে। 

এই বারো দিনের যুদ্ধে শত শত ইরানির মৃত্যু হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছেন বহু ইসরায়েলিও। অসংখ্য পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়েছে, নগরবাসী আতঙ্কে দিন কাটিয়েছে। ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, আর ইসরায়েল, তার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম এতো বেশি হুমকি ও ক্ষতির সম্মুখীন হলো। ইসরায়েলের বসবাসকারী ইহুদি নাগরিকদের দেশ ত্যাগের হিড়িক উঠেছে। পাশ্ববর্তী দেশ, সাইপ্রাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসরায়েলি ইহুদি জনগোষ্ঠী স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য জমি, ফ্ল্যাট কেনার ধুম লেগেছে যা সাইপ্রাসের স্থানীয় রাজনীতিতে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

এই সংঘাত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এই অঞ্চলের রাজনৈতিক বাস্তবতা কতটা বিস্ফোরণোন্মুখ। ইরান মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করতে চায়, ইসরায়েল আত্মরক্ষার নামে ইরান কে দমিয়ে রাখতে চায়, আর যুক্তরাষ্ট্র বারবার নিজের অবস্থান বদলায়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু যা দশকের পর দশক ধরে অমীমাংসিত। এসব মিলিয়ে টেকসই শান্তি এখানে এখনো সুদূরপরাহত।

যদি এই সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতিকে কোনভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করতে হয়, তাহলে তা হবে শুরু হিসেবে—স্থায়ী শান্তির দিকে প্রথম দুর্বল কিন্তু জরুরি পদক্ষেপ। এটাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, এই বিরতি হতে পারে ইসরায়েলের জন্য একটি কৌশলগত বিরতি যা তার পরবর্তী সংঘাতের জন্য প্রস্তুতির একটি পর্ব। এই নিরবতা হতে পারে পরবর্তী দীর্ঘ মেয়াদি ঝড়ের পূর্বাভাস। কেননা, ইসরায়েল কিন্তু তার আগ্রাসন এখনো চালিয়ে যাচ্ছে, তাও এবার নিরীহ ক্ষুধার্ত নারী ও শিশু থেকে সাধারণ ত্রাণপ্রার্থী গাজাবাসীর উপর।  

তবে, ইরানের সাথে আরো এক ধাপ অগ্রসর হলে এই সংঘাতের ফলাফল হতে পারত অকল্পনীয়। যুদ্ধ হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়ার হুমকি সৃষ্টি করেছিল—যে পথ দিয়ে বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ তেল পরিবাহিত হয়। এতে করে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে আগেই দাম হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল, এবং এক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের তেলে নির্ভরশীল দেশগুলো, যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, এমনকি জাপানের জন্যও এ ধরনের সংকট হতো বিধ্বংসী। মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি ঘাটতি, এবং সামাজিক অস্থিরতা—এসব আর কল্পনার বিষয় নয়, বরং বাস্তব ঝুঁকি হয়ে দরজায় কড়া নাড়ছিল।

অর্থনীতির বাইরে মানবিক ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও দ্রুত বিস্তৃত হতো। তবে, এই হামলা নেতানিয়াহু তার জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বলে একটি মত আছে। নেতানিয়াহু ইচ্ছাকৃতভাবে আঞ্চলিক উত্তেজনাকে উসকে দিয়ে নিজের জোট সরকারের পতন ঠেকাতে চাইছেন। এতে যুদ্ধাবস্থার মধ্যে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়ে তিনি তার বিচার ও রাজনৈতিক দুর্বলতা থেকে রেহাই পাচ্ছেন। তা আরও শক্তিশালী হয়েছে যখন ট্রাম্প তাঁর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক বার্তায় লিখেছেন," যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে রক্ষা করেছে, আর এখন যুক্তরাষ্ট্রই  নেতানিয়াহুকেও রক্ষা করবে।" তাই নেতানিয়াহুর প্রয়োজন এই অঞ্চলে এক দীর্ঘ মেয়াদি অস্থিরতা। 

যুদ্ধ বিরতির পরও  উভয় পক্ষই গোপন সাইবার হামলা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাচ্ছে—ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সাইবার হামলা চালিয়েছে, আর ইরান ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানে সাইবার অনুপ্রবেশ বাড়িয়েছে। সিরিয়া ও লেবাননে প্রক্সি সংঘর্ষ বেড়েছে, যেখানে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে, আর পাল্টা হামলায় উত্তরের ইসরায়েলেও রকেট নিক্ষেপ হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ আবারও পরমাণু চুক্তি (JCPOA) পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে, তবে ইসরায়েল  আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানাচ্ছে। 

তবে বাস্তবতা অনেক কঠিন। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা যতটা সহজ, বাস্তবায়ন ততটাই জটিল, বিশেষ করে যখন উভয় পক্ষ আদর্শগতভাবে একে অপরকে প্রতিরোধ কিংবা ধ্বংসের পথেই পরিচালিত করতে চায়। ইরান এখনো লেবাননের হেজবুল্লাহ থেকে শুরু করে ইয়েমেন, গাজা, ইরাক ও সিরিয়ার মিলিশিয়াদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধিবিরতির পরবর্তী সময়ে, ইরান তার সামরিক শিল্পাঞ্চল ইয়েমেনে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।  আর ইসরায়েল প্রায়শই অনাকাঙ্ক্ষিত আগ্রাসন, অবৈধ দখলদারিত্ব ও আগাম হামলাকে প্রতিরোধের বৈধ কৌশল বলে ধরে নেয় এবং তা সবসময়ই আন্তর্জাতিক কোনো জবাবদিহি ছাড়াই চালিয়ে যায়। এর পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্যের উল্লেখযোগ্য সুন্নি প্রধান দেশ গুলোর সরকারদের নিজের বলয়ে রেখে আঞ্চলিক অস্থিরতা জিইয়ে রেখেছে।

এর মধ্যেই ফিলিস্তিন সমস্যাকে বারবার অবহেলিত  করে রাখা হয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশা সমাধান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি কেবল মরীচিকা। গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি আগ্রাসন, অবরোধ, বসতি সম্প্রসারণ, ও বেসামরিক হতাহতের চিত্র গোটা আরব ও মুসলিম বিশ্বকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ফিলিস্তিন, ইরানের কাছে একটি ন্যায়সঙ্গত প্রতিরোধের প্রতীক তবে, এর আড়ালে তারা নিজের আঞ্চলিক অবস্থান শক্তিশালী করে তুলতে চাইছে।

যদি ইসরায়েল সত্যিকার অর্থে শান্তি চায়, তাহলে কেবল পরমাণু স্থাপনায় বোমাবর্ষণ নয়, বরং সহাবস্থানের সদিচ্ছা প্রমাণ করতে হবে। তাদের অবরোধ শেষ করতে হবে, অবৈধ দখলদারিত্ব বন্ধ করতে হবে, এবং ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার স্বীকার করতে হবে। কারণ শত্রুর কণ্ঠরোধ নয়, বরং তার প্রতিবাদের কারণ দূর করলেই আসবে নিরাপত্তা।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। ট্রাম্পের আচমকা মনোভাব পরিবর্তন, যেমন একদিকে শাসন পরিবর্তনের ডাক অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান যা আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যনীতি কতটা দোদুল্যমান, তা স্পষ্ট করে। একই সঙ্গে এটিও প্রমাণ করে যে, ওয়াশিংটন চাইলে এখনো পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে পারে এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। দশকজুড়ে তারা অস্ত্র বিক্রি, আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ, জাতিসংঘে ভেটো এবং ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা ছড়িয়েছে। কিন্তু চাইলে সেই আমেরিকাই হতে পারে ন্যায়বিচারের মধ্যস্থতাকারী।

এই মুহূর্তে প্রয়োজন বৈশ্বিক কোনো রাজনৈতিক নয়, নৈতিক নেতৃত্ব। যে নেতৃত্ব বোমার শব্দ নয়, কূটনীতির কণ্ঠস্বরকে প্রাধান্য দেয়। যে মানুষকে সংখ্যা নয়, প্রাণ বলে বিবেচনা করে। ইসরায়েল যেন সংঘর্ষ পুনরায় শুরু করার পায়তারা না করে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের প্রলোভনে না ফেলতে পারে তার প্রতি বৈশ্বিক নেতৃত্বকে সোচ্চার হতে হবে। আর ইরানকেও দেখাতে হবে সংযম ও দূরদর্শিতা। যুক্তরাষ্ট্র, যেই আসুক হোয়াইট হাউসে—তাদের উচিত হবে অন্ধভাবে পক্ষাবলম্ভন না করে, সমাধানের পক্ষে দাঁড়ানো।


লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। 


 এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :

১. আলোকিত বাংলাদেশ, ঢাকা : ০২ জুলাই,২৫

২. দৈনিক সংবাদ, ঢাকা : ০৩ জুলাই, ২৫