এম এ হোসাইন,
দ্য হেগ-এ অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক ন্যাটো সম্মেলনে যোগদানের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটিমাত্র মন্তব্য মাসের পর মাস ধরে চলা কৌশলগত পরিকল্পনাকে ছাপিয়ে গেল। এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকরা যখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি এখনো ন্যাটোর সম্মিলিত প্রতিরক্ষা নিশ্চয়তা সংবলিত অনুচ্ছেদ-৫ এর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন—জবাবে ট্রাম্প অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে বললেন, “আপনার সংজ্ঞার উপর নির্ভর করে।” এ যেন ট্রাম্পের কৌশলের সেই পুরোনো দৃশ্য—সুক্ষ্ম উস্কানি, দ্ব্যর্থতা, এবং আত্মরক্ষার রাস্তা খোলা রাখা।
এই মন্তব্যকে কেবল আরেকটি ‘কূটনৈতিক ভুল’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবে, ট্রাম্প পশ্চিমা প্রতিরক্ষা কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে এক গুরুতর প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন। অনুচ্ছেদ-৫ কোনো সাধারণ চুক্তির ধারা নয়। এটাই সেই প্রতিশ্রুতি, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আট দশক ধরে আটলান্টিকের দুই প্রান্তের মিত্রতাকে সংহত রেখেছে। এই ভিত্তিই যদি প্রশ্নের মুখে পড়ে, তাহলে পুরো কাঠামোটা ভেঙে পড়ুক আর না পড়ুক, এর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
ট্রাম্প এই মন্তব্যটি করেছেন একটি ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে, যার সূচনা হয়েছিল তার প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় । তিনি একাধিকবার ন্যাটোকে “অপ্রাসঙ্গিক” বলে আক্রমণ করেছেন, মিত্র দেশগুলোর সামরিক ব্যয় না বাড়ানো নিয়ে ভর্ৎসনা করেছেন এবং কখনো কখনো পুরো জোট থেকে সরে আসার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। যদিও সে সময় তা বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু মিত্র রাষ্ট্রগুলো তা ভুলে যায়নি। এখন দ্বিতীয় মেয়াদে এসে ট্রাম্প যেন সেই পুরোনো স্ক্রিপ্ট আবার চালু করেছেন—এইবার আরেকটু বেশি কঠোরভাবে।
ন্যাটোর ইতিহাসে একবারই অনুচ্ছেদ-৫ প্রয়োগ করা হয়েছিল - ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর, যখন আমেরিকাই ছিল হামলার শিকার। তখন বাকি সব মিত্র দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে আমেরিকার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সেই দৃশ্যপট ছিল ন্যাটোর প্রতিশ্রুতির এক শক্তিশালী প্রমাণ। এখন যদি এই প্রতিশ্রুতির ব্যাখ্যা নিয়েই সন্দেহ উত্থাপিত হয়, তাহলে যারা এই নিরাপত্তার উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে—বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো, তাদের মধ্যে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়াটা স্বাভাবিক।
অবশ্যই, ট্রাম্প সমর্থকদের বলার মতো যুক্তি আছে। তারা বলে, শীতল যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, ইউরোপ অনেক দিন ধরেই আমেরিকার নিরাপত্তা ছায়ায় থেকে সুবিধা নিয়েছে, এখন মিত্র দেশগুলোর উচিত নিজেদের বোঝা নিজেরা বহন করা। কিছুটা অংশে তারা ঠিকও বটে। ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যরা প্রায়ই কৌশলগত নিষ্ক্রিয়তার জন্য নিজেরাই দায়ী। তারা সন্তুষ্ট থেকেছে এই ভেবে যে, আমেরিকাই খরচ বহন করবে, আর তারা মনোযোগ দেবে কল্যাণ রাষ্ট্র ও সবুজ জ্বালানির পথে রূপান্তরের দিকে।
কিন্তু একজন দায়িত্বশীল নেতা কখনো নীতি সংশোধনের জন্য পুরো মানচিত্রে আগুন লাগিয়ে দেন না। ট্রাম্পের মন্তব্য কৌশলগত প্রণোদনা নয়, বরং তা উগ্র জাতীয়তাবাদের আবরণে ছদ্মবেশী হুমকি। এতে মিত্রদের মধ্যে সংস্কারের অনুপ্রেরণা আসে না, বরং প্রতিপক্ষের ভুল হিসাবের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে কী ভয়ঙ্কর ফল হতে পারে। ১৯৩০-এর দশকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যখন ইতালির মুসোলিনি বা রাইনল্যান্ডে হিটলারের আগ্রাসনের মুখে নির্লিপ্ত থাকল, তখন ফ্যাসিস্ট শক্তিরা তাদের আগ্রাসন আরও বাড়ানোর সাহস পেল। সেই যুগের শিক্ষাই বলেছিল—অস্পষ্টতা মানে দুর্বলতা, আর দুর্বলতা মানেই বিপর্যয়ের আমন্ত্রণ।
ট্রাম্পের এই অনুচ্ছেদ-৫ থেকে ভাষাগত পিছু হটা সেই ধরনের বিপজ্জনক সংকেত। পুতিনের কাছে এর মানে, ন্যাটো আর এককাট্টা নয়। বাল্টিক দেশ ও পোল্যান্ডের কাছে এর বার্তা, তাদের নিরাপত্তা এখন ওয়াশিংটনের এক ব্যক্তির মর্জির উপর নির্ভরশীল। এবং বিশ্বব্যাপী এর অর্থ, আমেরিকার প্রতিশ্রুতি এখন আর কৌশলগত নীতি নয়, বরং লেনদেনের বস্তু।
এই মন্তব্যে ইউরোপের নেতাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মার্জ সতর্ক করেছেন, ইউরোপ আর “ফ্রি রাইড” নিতে পারবে না। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, যিনি একসময় ন্যাটোকে “মৃত-মস্তিষ্ক” বলেছিলেন, এবার ট্রাম্পের বক্তব্যকে ইউরোপীয় কৌশলগত স্বনির্ভরতার স্বপক্ষে দলিল হিসেবে দেখছেন। এক সময় আদর্শবাদ বলে অবজ্ঞা করা ইউরোপীয় সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা এখন বাস্তব হয়ে উঠছে।
ট্রাম্পের অনির্ভরযোগ্যতা হয়তো এক অর্থে ইউরোপের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপ মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ নিরাপত্তার ছায়ায় থেকেছে, কিন্তু সেই ছায়ার মূল্য তারা দেয়নি। এখন সময় এসেছে ইউরোপের আত্মনির্ভরতার।
তবে এই আত্মনির্ভরতা শুধু বাজেট বাড়িয়ে অর্জন করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং সেই কঠোর বাস্তববাদ যা ১৯৪৫-এর পর ইউরোপ নিয়মতই এড়িয়ে গেছে। কারণ আজকের বিশ্বে, যেখানে কর্তৃত্ববাদী শক্তিগুলো পুনরুত্থিত, সেখানে কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচার দিয়ে প্রতিরক্ষা হয় না—প্রয়োজন শক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতা।
অন্যদিকে, রাশিয়ার প্রতি ট্রাম্পের নরম বার্তা ইউরোপীয় উদ্বেগকে আরও বাড়িয়েছে। ট্রাম্প যখন ক্রেমলিনের সাথে ব্যাকচ্যানেল চালু রাখেন, বা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এমন একটি সমঝোতার ইঙ্গিত দেন যা রাশিয়ার পক্ষে ঝুঁকে থাকে, তখন বোঝা যায়, তার আমলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থই অগ্রাধিকার পাবে। যেখানে বাইডেন কিয়েভের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ট্রাম্প সেখান থেকে হাত গুটিয়ে নিতে ব্যস্ত।
সমর্থকেরা একে বলে বাস্তববাদ, আর সমালোচকেরা বলেন আত্মসমর্পণ। কিন্তু যেটাই হোক না কেন, এতে ২০২২ সাল থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর যে নৈতিক ও কৌশলগত স্পষ্টতা ছিল, তা দুর্বল হয়ে পড়ে। এর চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক হলো—এটি পশ্চিমা ঐক্যে ফাটল ধরায় এমন এক সময় যখন মস্কো, বেইজিং এবং তেহরান ধীরে ধীরে হলেও একটি কার্যকরী ও প্রভাবশালী বিরোধী জোটে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।
এখানে ন্যাটো সম্মেলনের প্রতীকি গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এই প্রেক্ষাপটে হেগ-এ আয়োজিত ন্যাটো সম্মেলন, যেখানে ঐক্য, আধুনিকায়ন ও ইউক্রেনের সদস্যপদ অর্জনের পথ পরিষ্কার করার কথা ছিল, এখন এক বিভ্রান্তিকর প্রশ্নে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল—“যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের কথা রাখবে?”
শেষ পর্যন্ত, এ প্রশ্ন গিয়ে ঠেকে বিশ্বাসের জায়গায়। সেই বিশ্বাস—যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন সত্ত্বেও আমেরিকা এখনো মুক্ত বিশ্বের নির্ভরযোগ্য নেতৃত্ব বহন করে। বিশ্বাস যে, বিশ্ব যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে ওঠা জোটগুলো এখনো অর্থবহ। এবং বিশ্বাস যে- আবার যদি অনুচ্ছেদ-৫ পরীক্ষার মুখে পড়ে (আর তা একদিন পড়বেই), তখন কোনো দ্বিধা থাকবে না, কোনো শব্দের ব্যাখ্যা খোঁজা হবে না, এবং রাজনৈতিক সুবিধা ও নৈতিক দায়িত্বের তুলাদণ্ডে ওজন করা হবে না।
ন্যাটো’র শক্তি কখনো শুধু অস্ত্রশস্ত্র বা সৈন্যসংখ্যার ওপর নির্ভর করেনি। এর প্রকৃত শক্তি এসেছে সেই নিশ্চিত বিশ্বাস থেকে যে এর সদস্যরা একসঙ্গে দাঁড়াবে—স্বয়ংক্রিয়ভাবে, নিঃশর্তভাবে এবং বিশ্বাসঘাতকতার ভয় ছাড়াই। ট্রাম্পের এই অস্পষ্টতা সেই আত্মবিশ্বাসকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু বাইরের নয়—ভয়ংকর হল সেই সন্দেহ, যেটা আমরা নিজেরাই মনে জায়গা দিই। ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন, এটি নিপুণ দর কষাকষি; কিন্তু ন্যাটো কোনো ব্যবসা চুক্তি নয়। এটি এক রক্তস্নাত বন্ধন, যা সময়ের পরীক্ষায় গড়ে উঠেছে এবং আজকের অস্থির বিশ্বে এখনো অপরিহার্য।
হেগ-এর সম্মেলনকক্ষে যখন ন্যাটো নেতারা আগামী দশকের মধ্যে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তখন তাদের কর্তব্য কেবল এই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা নয়—বরং এমন এক ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়া, যেখানে এই প্রতিশ্রুতি হয়তো সকল সদস্যের পক্ষে আর বজায় রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। ইউরোপকে এখন প্রস্তুত হতে হবে রাজনৈতিকভাবে, সামরিকভাবে এবং নৈতিকভাবে—এক এমন বিশ্ব বাস্তবতার জন্য, যেখানে আমেরিকা হয়তো শুধু বক্তব্যে নয়, বরং নীতিগত অবস্থান ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণেও অনুপস্থিত থাকতে পারে। প্রশ্ন এখন আর এটি নয়—অনুচ্ছেদ-৫ প্রয়োগ করা হবে কি না। প্রকৃত প্রশ্ন হলো—যদি সেই মুহূর্ত আসে, তখন কেউ কেউ আদৌও সেই আহ্বানে সাড়া দেবে কিনা?
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :
১. সময়ের আলো, ঢাকা : ০৩ জুলাই,২৫