Wednesday, 2 July 2025

ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে নীরবতা

এম এ হোসাইন,

বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় হয়। চুক্তি হয়, নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়, আন্তর্জাতিক পরিদর্শনসহ সবই চলে নিরস্ত্রীকরণের নামে। কিন্তু এসব প্রচেষ্টার মধ্যেও একটি ব্যতিক্রম, যা বিশ্বের সবার চোখ এড়িয়ে যায় আর সেটি হলো ইসরাইলের গোপন পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার। কিন্তু কেন?

ইসরাইল কখনোই স্বীকার করেনি, তারা পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। অথচ সবাই জানে, তারা অনেক আগেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে। ডিমোনা চুল্লির মাধ্যমে ১৯৫০-এর দশকে তারা যে গোপন কর্মসূচি শুরু করেছিল, তা ১৯৮৬ সালে সাবেক প্রকৌশলী মরদেখাই ভানুনুর তথ্যফাঁসের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। তার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ইসরাইলের হাতে রয়েছে অনেকগুলো পারমাণবিক অস্ত্র। এরপর ভানুনুরকে অপহরণ করে ইসরাইলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও আমেরিকান সায়েন্টিস্ট ফেডারেশন জানায়, ইসরাইলের কাছে ৮০ থেকে ২০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, যেগুলো ভূমি, আকাশ এবং সমুদ্রপথে ব্যবহারযোগ্য। এমনকি তারা ‘সেকেন্ড-স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি’ অর্জন করেছে, অর্থাৎ হামলার পর পাল্টা আঘাত হানার সক্ষমতাও তাদের রয়েছে।

অথচ ইরান যখন শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তির জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করলে সেটি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) কঠোর পরিদর্শনের আওতায় পড়ে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয় এবং হামলার শিকার হয়। ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ সমর্থনের পেছনে রয়েছে ১৯৬৯ সালের এক গোপন চুক্তি, যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী গোলডা মেয়ার একটি সমঝোতায় পৌঁছান। এই সমঝোতা অনুযায়ী ইসরাইল পারমাণবিক অস্ত্র রাখবে, কিন্তু তা প্রকাশ করবে না। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা এই নীতিকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে ইহুদি বর্ণবাদী দেশটি ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের নীরবতা শুধু একটি অভ্যন্তরীণ নীতি নয়; বরং এটি এক দীর্ঘস্থায়ী বৈশ্বিক দ্বৈত মানদণ্ড দ্বারা সমর্থিত। পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে বৈশ্বিক চুক্তির ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) দিকে তাকালে দেখা যায়, ইসরাইল এই চুক্তিতে কখনোই স্বাক্ষর করেনি। এই চুক্তির বিধান অনুসারে, ১৯৬৭ সালের আগে যারা পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী ছিল না, তাদের জন্য এমন অস্ত্র তৈরি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি ইসরাইল এই চুক্তিতে যোগ দিত, তবে তাকে নিরস্ত্রীকরণে বাধ্য করা হতো। কিন্তু চুক্তির বাইরে থেকে ইসরাইল তার কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পেরেছে। অন্যদিকে, বিশ্বের বাকি দেশগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে এই চুক্তি মেনে চলতে।

ইসরাইলের মিত্ররা যুক্তি দেন, শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় ইসরাইলের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তার পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা বৈধ। কিন্তু যদি নিরাপত্তাহীনতা কোনো দেশের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বৈধতা দেয়, তবে বৈশ্বিক নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থা অর্থহীন। তাহলে একই যুক্তি কেন তেহরান, রিয়াদ বা কায়রোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না?

এই নীরবতা শুধু নৈতিক দ্ব্যর্থতা সৃষ্টি করে না, বরং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থার ভিতটাই দুর্বল করে দেয়। এনটিপি একটি নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছেÑতা হলো, যারা পরমাণু অস্ত্র ত্যাগ করে, তারা শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তি পাবে এবং যারা অস্ত্রধারী, তারা ধীরে ধীরে নিরস্ত্রীকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। কিন্তু যখন একটি দেশ স্থায়ীভাবে এই নিয়মের বাইরে থাকে, তখন অন্যরা এ ব্যবস্থায় আস্থা হারায়।

এই বোধের অনুপস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। সৌদি আরব ইতোমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছে, যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে তারাও একই পথে হাঁটবে। মিসরও পরমাণু অস্ত্র নিয়ে ইসরাইলের গোপনীয়তা এবং মধ্যপ্রাচ্যকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতির অভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র এই উদ্বেগে কোনো গুরুত্ব দেয়নি।

ফলে, মধ্যপ্রাচ্য এখন বিপজ্জনক এক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে, যা পুরো অঞ্চলকে মহাবিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

এই আশঙ্কার সামনে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে স্বচ্ছতার দাবি তোলা। এটি শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যও জরুরি। যদি বিশ্ব সত্যিকার অর্থে নিরস্ত্রীকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তবে সব দেশের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হতে হবে। আর যদি তা না হয়, তবে বার্তাটি হবে স্পষ্ট - বিশ্বব্যবস্থা নীতি নয়, শক্তির ভিত্তিতে চলে। আর এই চরম পক্ষপাতদুষ্ট নীরবতার খেসারত দিতে হতে পারে সমগ্র মানবজাতিকে।


লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।


এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :

১. আমার দেশ, ঢাকা : ০২ জুলাই,২৫

No comments:

Post a Comment