Friday, 25 July 2025

বিদেশি নির্বাচনে মার্কিন নীরবতার নতুন নীতি

এম এ হোসাইন,

দীর্ঘ কয়েক দশকের কূটনৈতিক প্রথা থেকে সরে এসে যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করে বিদেশি নির্বাচনের ব্যাপারে প্রকাশ্য মন্তব্য ও সমালোচনা নাটকীয়ভাবে সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর হাতে আসা এক নীতিপত্রে দেখা গেছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও স্টেট ডিপার্টমেন্টকে নির্দেশ দিয়েছেন—কোনো বিদেশি নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, স্বচ্ছতা বা বৈধতা নিয়ে আর কোনো মতামত না দিতে, যদি না সেটি স্পষ্টভাবে মার্কিন কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে জড়িত থাকে।

এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মূল্যবোধ প্রচারের দীর্ঘ ইতিহাস থেকে মৌলিকভাবে সরে আসা। বহু বছর ধরে, বিশেষত জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং বারাক ওবামা প্রশাসনের আমলে, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে কণ্ঠ তোলা ছিল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি। বাইডেন প্রশাসন সেই নীতি আরও জোরালো করে বেলারুশ, জর্জিয়ার মতো দেশে গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ নিয়ে সরাসরি সমালোচনা করেছিল।

কিন্তু রুবিওর নির্দেশ অনুযায়ী এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ও কূটনীতিকদের বলা হচ্ছে, “কোনো দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া কতটা সুষ্ঠু বা গণতান্ত্রিক, তা নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে। বরং বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানানো এবং প্রয়োজনে পারস্পরিক কূটনৈতিক স্বার্থের বিষয়গুলো তুলে ধরা যথেষ্ট।”

এই পরিবর্তন আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির ধারাবাহিকতা—যেখানে নৈতিক বা আদর্শিক হস্তক্ষেপের চেয়ে বাস্তবমুখী কূটনৈতিক লাভকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। নীতিপত্রে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, “যে দেশগুলোতে আমাদের কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে, তাদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করা হবে—তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যাই হোক না কেন।”

বর্তমান মার্কিন এই নীতিতে স্পষ্ট বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। কেবলমাত্র জাতীয় স্বার্থ রক্ষাই এখন অগ্রাধিকার, গণতন্ত্র রক্ষার নৈতিক প্রচারণা নয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি অন্য দেশের গণতান্ত্রিক মানদণ্ড নিয়ে প্রকাশ্য অবস্থান না নেয়, তাহলে স্বৈরশাসন বা ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র পরিচালনাকারী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা সহজ হবে—বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলছে।

তবে সমালোচকেরা মনে করেন, এই নীতি মার্কিন সফট পাওয়ার ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বৈশ্বিক কণ্ঠস্বর। হঠাৎ নীরব হয়ে যাওয়া মিত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বী উভয়ের কাছেই বার্তা দেবে—ওয়াশিংটন আর মানবাধিকার বা নির্বাচন-স্বচ্ছতার পক্ষে দাঁড়াতে প্রস্তুত নয়, যদি না তা সরাসরি মার্কিন স্বার্থে কাজে লাগে।

এই কৌশলগত মোড় ঘোরানোর সময়টাও বিতর্কিত। লাতিন আমেরিকায় সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এই দ্বিচারিতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। নির্বাচন-সংক্রান্ত মন্তব্য থেকে দূরে থাকার ঘোষণা দেওয়ার পরও ট্রাম্প প্রশাসন একই মাসে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ৫০% শুল্ক আরোপ করেছে এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট জায়ার বলসোনারোর বিচার প্রক্রিয়া থামানোর জন্য রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে।

বলসোনারো—যিনি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র—২০২২ সালের নির্বাচন বাতিলের চেষ্টা নিয়ে বর্তমানে ব্রাজিলে তদন্তের মুখে। ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলসোনারোর বিচার বন্ধের দাবি জানিয়েছেন, যা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা “বিশ্ব শাসন করার ঔদ্ধত্যপূর্ণ চেষ্টা” বলে সমালোচনা করেছেন। লুলার মন্তব্য লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত গ্লোবাল সাউথে তীব্র সাড়া তুলেছে।

এই বিরোধাভাস রুবিওর নির্দেশনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তুলে ধরে: ওয়াশিংটন হয়তো বেলারুশ বা জর্জিয়ার মতো দেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য বন্ধ করবে, কিন্তু যখন তা প্রভাবশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থে লাগে, তখন হস্তক্ষেপের অধিকার রেখেই দেবে। এই বেছে নেওয়া “অহস্তক্ষেপ” নীতি সহজেই ভণ্ডামি ও সুযোগসন্ধানীতার অভিযোগ ডেকে আনতে পারে।

আরেকটি আশঙ্কা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই পশ্চাদপসরণে যে শূন্যতা তৈরি হবে, তা পূরণ করবে কম নৈতিক পরাশক্তিরা। রাশিয়া ও চীন ইতিমধ্যেই অবাধ শর্তে স্বৈরশাসক রাষ্ট্রগুলোকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র আর গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতীক না থাকে, তাহলে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা আরও বিস্তার লাভ করতে পারে।

এর পাশাপাশি, যেসব দেশ গণতান্ত্রিক সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আশা করত—যেমন ভেনেজুয়েলা, মিয়ানমার বা সুদান—তারা এখন নিজেকে পরিত্যক্ত মনে করতে পারে। তাদের শাসকগোষ্ঠী বুঝে যাবে, ওয়াশিংটন আর আন্তর্জাতিক নজরদারির হাতিয়ার নয়।

ইউরোপের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ। সোভিয়েত দখল থেকে মুক্ত হওয়া পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ এখনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান মজবুত করতে মার্কিন কূটনৈতিক সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। রুবিওর নতুন নীতি ইঙ্গিত দেয়—তাদের জন্য এই সহায়তা ভবিষ্যতে আর আদর্শিক ন্যায়ের প্রশ্নে আসবে না, বরং কেবল তখনই আসবে যখন তা ওয়াশিংটনের কৌশলগত স্বার্থে কাজে লাগবে।

কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এই পরিবর্তনের পেছনে দেশীয় রাজনৈতিক হিসাবও রয়েছে। ট্রাম্প ও তার সমর্থকেরা বরাবরই অভিযোগ করেছেন—বিদেশি নির্বাচনের সমালোচনা আসলে ভণ্ডামি, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক আছে। ভবিষ্যতে আমেরিকার গণতন্ত্র নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা ঠেকাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে “বৈশ্বিক নির্বাচনী বিচারকের” ভূমিকা থেকে সরিয়ে নিতে চাইছে।

অন্যদিকে, বিদেশি নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে মন্তব্য না করলে আমেরিকা নিজের অস্থির রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আড়াল করতেও পারবে। অভ্যন্তরীণ মেরুকরণ, ভোটার দমন অভিযোগ ও ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়িতে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক উচ্চভূমি আগের মতো অটুট নেই।

অতএব, রুবিওর এই নির্দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এক গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে—একটি মূল্যবোধনির্ভর কূটনীতি থেকে সরাসরি স্বার্থনির্ভর কূটনীতির দিকে। এতে স্বৈরশাসক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক হয়তো সহজ হবে, কূটনৈতিক বার্তাও সরল হবে; কিন্তু এর ঝুঁকিও বিরাট। সংস্কারপন্থী, মানবাধিকারকর্মী ও গণতান্ত্রিক সরকারগুলো, যারা একসময় ওয়াশিংটনকে অগ্রগতির অংশীদার ভাবত, তারা হয়তো আর সেই আস্থা রাখবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে—এই পরিবর্তন কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও স্থিতিশীল ও বাস্তবমুখী কূটনীতি বয়ে আনবে, নাকি গণতন্ত্রপন্থী কণ্ঠরোধ করে বৈশ্বিক কর্তৃত্ববাদকে ত্বরান্বিত করবে? কৌশলগত নীরবতা বেছে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো নিজের কূটনৈতিক উত্তরাধিকার নতুনভাবে লিখছে—কিন্তু তা ভালো ফল বয়ে আনবে, তার নিশ্চয়তা নেই।



লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। 


  এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :

১. সময়ের আলো, ঢাকা : ২৬ জুলাই, ২৫

No comments:

Post a Comment