Thursday, 10 July 2025

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

 এম এ হোসাইন,

ভূ-রাজনীতিতে প্রতীকী গুরুত্ব ও বাস্তবতা প্রায়শই পাশাপাশি চলে। সম্প্রতি ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য ব্রিকস সম্মেলন তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পশ্চিমা গণমাধ্যম যেখানে এই সম্মেলনকে গুরুত্বহীন উপখ্যানের মতো উপস্থাপন করেছে, এটিকে উদীয়মান অর্থনীতির আরেকটি সাধারণ সমাবেশ হিসেবে খাটো করে দেখার চেষ্টা করেছে, সেখানে ব্রিকস জোটের যৌথ ঘোষণা একটি অনেক গভীরতর বাস্তবতার ইঙ্গিত দিয়েছে: পশ্চিমা আধিপত্যের ধীর কিন্তু অনিবার্য ক্ষয় এবং বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থার উত্থান।

ব্রিকস-এর এই ঘোষণাপত্র এমন একটি সত্যকে সামনে এনেছে, যা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাহলো, বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা আর কেবল কল্পনা নয়, এটি এখন একটি ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বিশ্ব এমন এক ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়ে এসেছে, যা তথাকথিত ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’-এর উদারনৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত। তবে, বাস্তবতা হলো এই ব্যবস্থা প্রায়শই নব্য-ঔপনিবেশিক শোষণের পাতলা আবরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আজ সেই ঐকমত্য ভেঙে পড়ছে। আর ব্রিকস—যার সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সম্প্রসারিত হয়ে ইন্দোনেশিয়ার মতো নতুন সদস্য যুক্ত করছে, তা এই পরিবর্তনের অন্যতম রূপকার হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।

ব্রিকসের সম্মিলিত ঘোষণার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিকগুলোর একটি ছিল, ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি তাদের সুস্পষ্ট সমর্থন। জোটটি গাজায় অবিলম্বে ও নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি, ইসরায়েলি বাহিনীর প্রত্যাহার, জিম্মিদের মুক্তি এবং অবাধ মানবিক সহায়তা প্রবাহের আহ্বান জানিয়েছে। এই অবস্থান পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিমুখী নীতির বিরুদ্ধে এক স্পষ্ট প্রতিবাদ।

এই বিপরীতে দৃশ্যপটটি অত্যন্ত শিক্ষণীয়। যখন রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায়, পশ্চিমা বিশ্ব দ্রুত নিন্দা, নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক সহায়তা পাঠাতে তৎপর হয়। অথচ যখন ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে গাজায় অসংখ্য বেসামরিক মানুষ নিহত হয়, তখন পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া প্রায়শই মৃদু, অস্পষ্ট বা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থেকে যায়। তাই, ব্রিকস যথার্থভাবেই এই দ্বিচারিতার প্রতি আঙুল তুলেছে। রাজনৈতিক মেরুকরণের উর্ধ্বে উঠে আন্তর্জাতিক আইন ও প্রতিটি মানুষের মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আহ্বান জানিয়েছে।

এটি শুধু কথার কথা নয়। ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি এই আহ্বান ১৯৫৫ সালের বান্দুং সম্মেলনের চেতনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়—যেখানে উপনিবেশ-উত্তর দেশসমূহ একত্রিত হয়ে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বাইরে নিজেদের পথ নির্ধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই অর্থে, ব্রিকস কোনো নতুন পথ তৈরি করছে না; বরং একটি পুরনো, কিন্তু প্রয়োজনীয় পথকে পুনর্জীবিত করছে। যে পথটি বিশ্ববাসীকে আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়া জরুরি।

ব্রিকস-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষণশীল বাণিজ্যনীতি এবং একতরফা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা, যা জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে দেয়। শুল্ক, অশুল্ক বাধা এবং তথাকথিত ‘সবুজ সুরক্ষা’ নীতির বিরোধিতা করে দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক বাণিজ্যের নিয়মগুলো কীভাবে উন্নত অর্থনীতির পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট ছিল, ব্রিকস সম্মেলনে ঐ বিষয় গুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। 

ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা বিশ্ব মুক্ত বাণিজ্যের কথা বলেছে, কিন্তু নিজেদের স্বার্থে সুবিধাজনক সময়ে সংরক্ষণশীল নীতি প্রয়োগ করেছে। এক সময় মুক্ত বাজারের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা ছিল যুক্তরাষ্ট্র, অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি শুল্ককে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। চীনের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে শুরু করে বাইডেন প্রশাসনের ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ ও ‘পরিবেশ সুরক্ষা’র অজুহাতে আরোপিত কঠোর নীতিমালাও এই ধারারই অংশ।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে ব্রিকস। বিশেষ করে এর বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের দাবিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বিরাজমান গভীর হতাশা প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা দূর্বলদের মূল দিয়ে ক্ষমতাবানদের স্বার্থ রক্ষা করে। এটি শুধু অর্থনৈতিক অসন্তোষই নয়; বরং ন্যায়বিচারের এক স্পষ্ট আহ্বান।

এছাড়াও, ইসরায়েলী বাহিনীর দখলকৃত সিরীয় ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবি এবং অঞ্চলজুড়ে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের নিন্দা ব্রিকস-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তুলে ধরেছে। এটি ছিলো রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান। ইরাক থেকে লিবিয়া পর্যন্ত পশ্চিমা হস্তক্ষেপের ফলশ্রুতিতে দেখা গেছে বিধ্বস্ত রাষ্ট্র, বিপর্যস্ত মানবসমাজ যা প্রায়শই গণতান্ত্রিকীকরণ বা মানবিক হস্তক্ষেপের নামে ঘটেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রিকস নিজেকে বিকল্প এক কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। যে কণ্ঠস্বর সামরিক দুঃসাহসিকতার বিপরীতে সার্বভৌমত্ব, বিনা-হস্তক্ষেপ ও সংলাপকে অগ্রাধিকার দেয়।

সিরিয়ার উপর একতরফা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার—যা ব্রিকস  আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। এই প্রত্যাহার সেই ইঙ্গিত দেয় যে, এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রায়শই লক্ষ্যভূক্ত শাসকগোষ্ঠীর চেয়ে সাধারণ জনগণের উপর বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এটি এক সূক্ষ্ম অবস্থান, যা অতীতের পশ্চিমা হস্তক্ষেপের ব্যর্থতার প্রতিধ্বনি এবং আরো ভারসাম্যপূর্ণ পন্থার জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

ইউক্রেনের পক্ষ থেকে রাশিয়ার বেসামরিক অবকাঠামোর উপর হামলার নিন্দা জানিয়েছে ব্রিকস যা পশ্চিমা দৃষ্টিকোণে বিতর্কিত। এই জোটের নীতিগত অবস্থানের প্রতিফলন হলো যে কোনো পক্ষের দ্বারা সাধারণ নাগরিকদের উপর সহিংসতার বিরোধী। যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব একচোখা দৃষ্টিতে কেবল রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়েই ব্যস্ত, সেখানে ব্রিকস চাইছে এক ব্যাপকতর দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে সব ধরণের বেসামরিক হামলা, তা যে পক্ষ থেকেই হোক, সমানভাবে নিন্দোনীয়।

এই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হয়তো পশ্চিমা বর্ণনার সাথে মিলবে না, তবে এটি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ব্রিকস-এর অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ—একটি নীতিগত অবস্থান, যা ভূ-রাজনৈতিক সুবিধার জন্য প্রায়শই বিসর্জিত হয়ে থাকে।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক ঘটনা ছিল ব্রিকস-এর সম্প্রসারণ। ইন্দোনেশিয়ার আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তি এবং বেলারুশ, বলিভিয়া, কাজাখস্তান, কিউবা, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, উগান্ডা ও উজবেকিস্তানের মতো নতুন অংশীদার দেশের স্বীকৃতি বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

এটি কোনো সরাসরি পশ্চিমবিরোধী জোট নয়। বরং এটি এমন এক গোষ্ঠী, যারা ক্রমবর্ধমান মেরুকৃত বিশ্বে নিজেদের কৌশলগত বিকল্প প্রসারিত করতে চায়। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ব্রিকস-এর দিকে ঝুঁকছে পশ্চিমা সম্পর্ক অস্বীকার করার জন্য নয়, বরং নিজেদের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা বহুমুখীকরণের জন্য। এটি সেই বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, যেখানে অপেক্ষাকৃত ছোট শক্তিগুলো আর পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শুধু ‘মেরুদণ্ডহীন দাবার ঘুটি’ হতে চায় না।

ব্রিকস-এর নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB) এবং কনটিনজেন্ট রিজার্ভ অ্যারেঞ্জমেন্ট (CRA), বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ-এর কার্যকর বিকল্প হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাতে নিরপেক্ষ হলেও বাস্তবে পশ্চিমা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। রাজনৈতিক শর্ত ছাড়া অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদান করে ব্রিকস উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিজস্ব উন্নয়নগত নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করছে।

তবে এর অর্থ এই নয় যে ব্রিকস-এর কোনো অভ্যন্তরীণ অসংগতি নেই। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বিরোধ, ভারত-চীনের মধ্যে বিরাজমান অবিশ্বাস এবং সদস্য দেশগুলোর ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থা—এসবই ঐক্যের পথে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এসব বৈপরীত্যের মাঝেও সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য জোটটির সক্ষমতাকে খাটো করে দেখা উচিত হবে না।

২০২৫ সালের রিও ডি জেনেইরো সম্মেলন হবে একটি পরীক্ষা। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তাদের সম্পৃক্ততা গভীরতর করলে, তাদের সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করবে ব্রিকস কি সত্যিই পশ্চিমা আধিপত্যের একটি কার্যকর পাল্টা শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে, নাকি বৈচিত্র্যের ভারে নিজেই পথ হারাবে।

অবশেষে ব্রিকস শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক জোট নয়; এটি গ্লোবাল সাউথের নতুন এক ‘ক্ষমতার উত্থান’-এর প্রতীক। দীর্ঘকাল ধরে বৈশ্বিক ব্যবস্থার রেখাচিত্র অঙ্কিত হয়েছে ওয়াশিংটন, লন্ডন আর ব্রাসেলসের সভাকক্ষে। সেই যুগ শেষের পথে। ফিলিস্তিন, বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং সার্বভৌমত্ব বিষয়ে ব্রিকস-এর ঘোষণা একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে: বিকল্পের যুগ এসে গেছে। আর যখন বিকল্প থাকে, তখন ক্ষমতা আর কেবল গুটিকয়েকের একচেটিয়া সম্পদ হয়ে থাকে না।



লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। 


এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে :

১. দৈনিক সংবাদ, ঢাকা : ১১ জুলাই, ২৫

২. সময়ের আলো, ঢাকা : ১২ জুলাই, ২৫

No comments:

Post a Comment